Shonar Boroni Konna | Mehazabein Chowdhury | Tawsif Mahbub | Channeli TV
Shonar Boroni Konna | Mehazabein Chowdhury | Tawsif Mahbub | Channeli TV
অজস্র কৌতূহল নিয়ে যখন মেহেদি চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করে তখন স্বভাবতই তাঁর হাত দুটো থরথর করে কাঁপতে থাকে, তাঁর ঐ উন্মুক্ত কপাল বেয়ে ঘাম ঝরতে শুরু করে এবং মুহূর্তেই তাঁর চোখদুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করে।
মুনিম রাইসার ব্যপারে কথা বলার জন্য যখন মেহেদির রুমে আসে তখন সে তাঁর নিজের ছোট ভাইকে এমন ভয়ার্ত মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাকই হয়। কিছুটা কাছে এসে সে মেহেদির কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে,
-কি হয়েছে? তোকে এমন লাগছে কেন আর এত চিন্তার কি আছে? রাইসাকে আমরা ঠিকই খুঁজে বাড়িতে নিয়ে আসবো।
ভাইয়ের কথার কোনো প্রতিউত্তর না দিয়ে মেহেদি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে চিঠিটা তাঁর দিকে এগিয়ে দেয়। কৌতূহলবসত মুনিম আর কিছু না বলেই চিঠিটা নিজের হাতে নিয়ে পড়া শুরু করে,
.
প্রিয় মেহেদি,
যদিও তুমি আমার কাছে কোনোদিনই প্রিয় ছিলে না তবুও প্রিয় সম্বোধন করছি এই কারণে যে স্বামী হিসেবে তুমি আমার কাছে একজন আদর্শ স্বামীর মতোই ছিলে। কিন্তু জেনে অবাক হবে যে আমি এখানে তোমার সাথে সংসার করার উদ্দেশ্যে আসিনি বরং এসেছিলাম এক ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ নিতে। এখন তোমার মনে নিশ্চই হাজারো প্রশ্ন জাগছে যে কিসের এমন প্রতিশোধ কিংবা কার প্রতিই বা এমন প্রতিশোধ নিতে এসেছিলাম আমি? এই ঘটনার মূল উৎস সম্বন্ধে জানতে হলে যেতে হবে সেই বাইশ বছর আগে। তুমি আজ তোমার পরিবারকে যে এতোটা অবস্থাসম্পন্ন দেখতে পাচ্ছো কিন্তু বাইশ বছর আগে তোমার পরিবার এতোটাও ধনী ছিল না। এক রাতে তোমার বড় ভাই এবং তোমার বাবা গঞ্জের দোকান থেকে কাজ সেড়ে বাড়িতে ফেরার সময় এক অসহায় নারীর মুমূর্ষু স্বামীকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে তাঁদের বাড়িতে প্রবেশ করে। সেদিন তোমার বাপ ভাই সেই লোকটিকে হসপিটালে নিয়ে যেতে সাহায্য করলেও তাঁদের ঐ লোভাতুর চোখদুটো আটকে গিয়েছিল সেই মহিলার বাড়ির নামিদামি আসবাবপত্রের দিকে। তাই নিজেদের লোভকে সংবরণ করতে না পেরে এর কিছুদিন পরেই তোমার বাবা এবং বড় ভাই সেই বাড়িতে চুরি করতে আসে। কিন্তু চুরির সময় বাড়ির কর্তা তাঁদেরকে দেখে ফেলায় তাঁরা প্রচন্ড ভয়ের রেশ ধরে বাড়ির কর্তাকে মাথায় আঘাত দিয়ে অজ্ঞান করে ফেলে এবং এর ঠিক পরমুহূর্তেই যখন সেই মহিলাটিও তাঁদের দেখে ফেলে তখন তাঁরা তাকেও মেরে ফেলতে দ্বিধা করেনি। শুধু তাই নয় সাথে সাথে বাড়ির কর্তাকেও সেই অজ্ঞান অবস্থাতেই শ্বাসরোধ করে হত্যা করে তাঁরা। তুমি হয়তো ভাবছো আমি এত কিছু জানি কিভাবে কিংবা তাঁদের সাথে আমার সম্পর্কটাই বা কি? হ্যাঁ তাঁরাই ছিল আমার বাবা মা এবং আমি ছিলাম তাঁদের একমাত্র মেয়ে। সেদিন তোমার বাবা এবং ভাই হিংস্রতার পরিচয় দিলেও আমাকে তাঁরা মারেনি। হয়তো ভেবেছিল এইটুকু তিনবছরের বাচ্চা আমাদের কিইবা এমন করবে? কিন্তু তাঁদের এই ধারণার পুরোটাই ছিল ভ্রান্ত বিশ্বাসে পরিপূর্ণ। তাঁরা হয়তো জানতো না ঐটুকু তিনবছরের বাচ্চাই একদিন তাঁদেরকে পরকালের টিকেট ধরিয়ে দিবে। এখনতো তোমার মনে নিশ্চই প্রশ্ন জাগছে যে আমি প্রতিশোধটা নিলাম কিভাবে তাইতো? তোমরা ভাবছো যে তোমার বাবা রোড এ্যাক্সিডেন্টে মারা গিয়েছে কিন্তু এটা সম্পূর্ণই ভুল ধারণা ছিল। কারণ আমি তাকে এমনভাবে মেরে দিয়েছি যাতে কেউই বুঝতে না পারে এটা এ্যাক্সিডেন্ট বৈ কি কোনো খুন নয়। আর তোমরা যাকে এতোদিন যাবৎ কাজের লোক ভেবে এসেছিলে সেই সালমাও কিন্তু আমারই লোক এমনকি তোমার ভাইয়ের স্বর্ণ চুরি কিংবা তাকে বিঁশ খাইয়ে যে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিয়েছে সেও আমারই লোক। তোমার মা নিঃসন্দেহে একজন ভালো মহিলা ছিল কিন্তু সে যদি তোমার বাবা কিংবা ভাইয়ের পক্ষপাতিত্ব না করতো তবে তাকেও এমন কষ্ট করে মরতে হতো না। তোমার মা আমার বাবা মাকে খুন করার ব্যপারে পুরোটাই জানতো কিন্তু তিনিও অর্থের লোভে নিজের স্বামী এবং ছেলের বিষয়টি চিরতরে মাটি চাপা দিয়েছিলেন তাই তাঁরও আর শেষ রক্ষাটি হলো না।
সৃষ্টিকর্তা হয়তো অন্যান্যদের তুলনায় আমাকে স্মৃতিশক্তির পরিমাণটা একটু বাড়িয়েই দিয়েছিলেন তাইতো আমি এত বছরেও তোমার বাপ ভাইয়ের চেহারাটা একটুও ভুলিনি। তোমাকে বিয়ে করার আমার একটাই কারণ ছিল আর তা হলো তোমার পরিবার সম্পর্কে খুব ভালোভাবে জেনে অতঃপর ঝোপ বুঝে কোপ মারা। আমি কখনোই আমার বাবা মায়ের আত্মসাৎকৃত অর্থ তোমাদেরকে ভোগ করতে দিবো না তাই সালমা এবং শফিকের সাহায্যে আমি তোমাদের সবকিছুই ছিনিয়ে নিয়েছি। তুমি আজ হয়তো আমাকে প্রচন্ড ঘৃণা করবে কিন্তু এর থেকেও প্রকট ঘৃণা আমার মনে জন্ম নিয়েছিল তোমার পরিবারের প্রতি বহু আগেই।
আমাকে কিংবা আমার সহকর্মীদের খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করোনা কারণ আমরা সবাই চলে গিয়েছি দূর বহুদূর তাই তোমরা কেন কোনো পুলিশও আমাদের খুঁজে পাবেনা। ডিভোর্স লেটারটা আমি আগে থেকেই রেডি করে রেখেছিলাম আর সেটা টেবিলের উপরে রাখা খামের ভিতরেই লুকায়িত আছে। আমি সই করে দিয়েছি এখন তুমি সই করবে কিনা সেটা একান্তই তোমার ব্যক্তিগত ব্যপার।
বাবা মায়ের খুনের প্রতিশোধটা নিতে তোমার সাথে বিয়ের অভিনয়টা করতেই হলো নাহলে এতোটা নিখুঁতভাবে কোনোদিনই এই ভয়ঙ্কর প্রতিশোধটি নিতে পারতাম না বোধহয়। পরিশেষে ক্ষমা চেয়ে তোমাকে আর লজ্জা দিতে চাইনা।
ইতি
তোমার প্রতিশোধপরায়ণ প্রাক্তন বউ রাইসা।
.
চিঠিটি পড়া শেষ হতে না হতেই মুনিম ধপ করে মেঝেতে বসে পরলো। এইমুহূর্তে রাইসার থেকেও তাঁর সবথেকে বেশি ঘৃণা হচ্ছে নিজের বাবা মা ও বড় ভাইয়ের প্রতি। কারণ তাঁরা যে এমন ভয়ঙ্কর রকমের খুনি ছিল সেটা মুনিমের ভাবনাতেই আসছে না। এই কদিনে স্বজন হারানোর বেদনায় দুইভাই কাতর হয়ে গেলেও আজ এই চিঠি পড়ার পর থেকে মূদ্রার এপিঠ ওপিঠের ন্যায় দুভাইয়ের মনমানসিকতা মুহূর্তেই পাল্টে যায়।
ইতোমধ্যে মিরা আসল সত্যটা জানার পর থেকে সে বুঝতে পারে এতোদিন যাবৎ তাবিজের কোনো ক্যারিশমাই এখানে ছিল না বরং এটা শুধুই তাকে ধোঁকা দেওয়ার এক প্রয়াস ছিল মাত্র।
.
মুনিম আর মেহেদি দুইভাই সবকিছু ভুলে আবার নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করেছে। তাঁরা জানে যে তাঁরা কোনো ভুলই করেনি তাই তাঁদের বাপ ভাইয়ের মতো এমন নিকৃষ্ট স্বভাবী পুরুষের শোকে কেনইবা তাঁরা নিজেদেরকে থমকে রাখবে? তবুও রক্তের সম্পর্কের প্রতি একটা মায়া থেকেই যায় সকলের।
বড় ভাবী সুমি আসল সত্যটা জানার পর থেকে কেমন যেন নিশ্চুপ হয়ে গেছে। কিন্তু তিনি সবাইকে সাবধান করে দিয়েছেন যেন তাঁর ছেলেমেয়ে দুটো বাবার এমন নিকৃষ্ট কর্মকান্ডের ব্যপারে কিছু জানতে না পারে। রাইসা চলে যাওয়ার বেশকিছুদিন পর সুমিও ছেলেমেয়েদের নিয়ে নিজের বাপের বাড়িতে চলে যায়। কারণ সে চায়না নিজের দেবরদের উপর বসে বসে খেতে।
মিরা ইদানিং প্রায়শই মন খারাপ করে বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। এই বাড়িতে এখন সে কেমন যেন একা হয়ে গেছে। হঠাৎই মিরার ফোনটি বেজে উঠলো, রিসিভ করতেই সে বাবার কন্ঠস্বর শুনে বেশ অবাক হয়। কারণ ওর মা ব্যতীত সচরাচর ওর বাবা কখনোই ওর সাথে তেমন কথা বলেনা।
-হ্যাঁ বাবা বলো।
-তোর মা তো একটা বিশাল অঘটন ঘটিয়ে ফেলছে।
বাবার এমন কথায় মিরা সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
-কি করেছে মা?
-আরে কোন এক কবিরাজকে সে বাড়িতে দাওয়াত দিয়েছিল। কিন্তু সেই কবিরাজ তাকে তাবিজ দেওয়ার নাম করে কি জানি খাইয়ে অজ্ঞান করে ফেলে। অতঃপর ঘরে কেউ না থাকায় আমাদের আলমারী থেকে এক লাখ বিশ হাজার টাকা আর তোর মায়ের সব স্বর্ণগহনা নিয়ে লম্পট দিছে। তোর মাকে আমি কতবার বলেছি যে এইসব তাবিজ কবজ হইলো সব ভুয়া কিন্তু তিনিতো আমার কথা একদমই শুনলেন না উল্টো কবিরাজকে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে আসছে। আমি আর তোর মাকে নিয়া থাকতে রাজি না, এই মহিলা বিয়ের পর থেকেই আমার জীবনটা ত্যানাত্যানা বানাইয়া ফালাইছে। এখন যা করার তুই কর।
বাবার এমন কথায় মিরা স্তব্ধ হয়ে যায়। সে জানতো একদিন না একদিন তাবিজের প্রতি ওর মায়ের অন্ধবিশ্বাসই তাঁর অধঃপতন ডেকে আনবে কিন্তু এই কথাটি যে এতোটা দ্রুত সত্যতে পরিণত হবে সেটা মিরার ভাবনাতেই আসছে না। সে তাঁর বাবার কথার প্রতিউত্তরে কিছু না বলে আস্তে করে ফোনটা কেঁটে দিল। কারণ এতোগুলো দুঃসংবাদ সহ্য করতে করতে এখন আর কোনো দুঃসংবাদ শুনতেই তাঁর আর ভালো লাগছে না।
.
রাইসা, সালমা, শফিক এবং রাইসার কথিত মামা মামী বসে আছে সমুদ্র সৈকতের কোল ঘেঁসে থাকা একটি রিসোর্টে। সালমা নীরবতা ভেঙ্গে বলে উঠলো,
-রাইসা আপা, এখন আমরা কি করবো?
-কি করবি আবার? তোর আর শফিকেরতো অনেক আগে থেকেই ইচ্ছা যে দুজন ভিনদেশে পাড়ি জমাবি এবং সেখানে তোদের বাচ্চাকাচ্চা হবে আর দুজন সুখে শান্তিতে বসবাস করবি। তাছাড়া তোরা দুজন যেই পরিমাণের স্বর্ণালংকার আর টাকাপয়সা চুরি করেছিস তা দিয়েতো পুরোটা জীবন বসে বসে খেতে পারবি।
রাইসার কথা শুনে শফিক বলে উঠলো,
-হুম আপা আমরাতো নিজেদের ইচ্ছা পূরণ করবোই কিন্তু আপনার কি হবে? আপনি কি বাকি জীবনটা এভাবেই কাঁটিয়ে দিবেন? আর আপনি আমাদের জন্য ছোটবেলা থেকে যা করেছেন সেই কথা মনে হলেতো আপনাকে একটুও একা ছেড়ে যেতে ইচ্ছা হয়না।
-আমাকে নিয়ে তোদের ভাবতে হবেনা আর আমি তোদের জন্য যা কিছু করেছি তাঁর থেকেও তোরা আমার জন্য বেশি কিছু করেছিস। তোরা দুজন না থাকলে বোধহয় আমি বাবা মায়ের হত্যার প্রতিশোধটাই নিতে পারতাম না। এখন এসব বাদ, আগে বল তুই এতোটা নিখুঁতভাবে বড় ভাইকে খুন করলি কিভাবে? এমনকি পুলিশরাওতো বুঝতে পারলোনা।
শফিক কিছুটা বাঁকা হাসি দিয়ে বললো,
-এইসব আমার বা হাতের খেল! প্রথমেই আমি চুপিচুপি রাতের বেলা তাঁর বাড়ির ফ্ল্যাটে নক করি, যেহেতু গত তিনবছর যাবৎ তাঁর এ্যাসিস্ট্যান্ট থাকার কারণে তাঁর দৈনন্দিন সবকিছুই নিজের মধ্যে আয়ত্ত করে নিয়েছি তাই আর বেশি বেগ পেতে হয়নি। যখন দরজায় নক করার পর তিনি দরজা খুলে আমাকে দেখলেন তখন স্বভাবতই তাঁর মেজাজ চরম পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। সে কিছু করার আগেই তাঁর মুখ বরাবর একটা চেতনানাশক ঔষধ স্প্রে করে দেই। অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর দরজার সামনে থেকে তাকে ডাইনিং টেবিলে একা একাই নিয়ে যাই। অতঃপর বিঁষের বোতলটা খুলে ঐ অচেতন অবস্থাতেই তাঁর মুখের মধ্যে বিঁষ ঢেলে দেই। সবশেষ বিঁষের বোতলটা এমনভাবে ফেলে রাখি যাতে মনে হয় সে নিজেই বিঁষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। আর দরজার লক সম্বন্ধে আমার আগে থেকেই অভিজ্ঞতা ছিল তাই দরজাটা ভেতর থেকে লাগিয়ে দেওয়াটাও আমার কাছে তেমন কোনো বিষয় ছিল না। এরপর আর কি? খুশি মনে চলে আসি!
এই বলেই শফিক হাসতে শুরু করলো। ওর হাসি দেখে একটুও বুঝতে বাকি থাকলোনা বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে ছেলেটি আসলেই গ্রান্ডমাস্টারদের থেকে কোনো অংশে কম নয়।
-বাহ! বেশ ভালোভাবেইতো কাজটা করে ফেললি কিন্তু এদিকে তোর বউতো ধরাই খেয়ে গিয়েছিল।
শফিক বেশ বড় চোখ করে বললো,
-কেনো? কিভাবে কি করেছে ও?
-আরে আর বলিস না। আমার মেঝো জা মিরা যেহেতু আমাদের প্ল্যানের মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে তাই ওকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম তাকে চোখে চোখে রাখতে। একটা পর্যায়ে যখন আমরা বুঝতে পারি যে মিরা তাবিজ কবজে বিশ্বাসী তাই ওর দৃষ্টিটা অন্যদিকে ঘুরানোর জন্য তোর বউকে আমি বিভিন্ন ভুয়া তাবিজ মিরার আশেপাশে রাখতে বলি যাতে ও এগুলো দেখে সতর্ক হয়ে যায়। কিন্তু সালমা একটু এ্যাডভান্স করতে গিয়ে প্রায় ধরাই পরে যাচ্ছিল। ও মিরার তাবিজখানা সরিয়ে অন্য একটি তাবিজ শাশুরীর বিছানার নিচে রেখে দেয়। যদিও এটা ভালো একটা চাল ছিল কারণ পরদিন শাশুরীকে বিঁষ খাওয়ানোর সময় ঐ চালটা ভালোভাবেই কাজে এসেছিল। কিন্তু এই বোকায় তাবিজটা রেখে আসার সময় মিরার চোখে ধরা পরে যায় আর সেটা আমি রাতের বেলা একটু ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় দেখে ফেলি। এরপর থেকে মিরা ওকে সন্দেহ চোখে রাখতো তাই সবকিছুই সাবধানতার সাথে করতে হয়েছে। একবার যদি ধরা পরতো তাহলে আমও যেত ছালাও যেত।
রাইসার কথায় সালমা বেশ লজ্জা পেয়ে বলে,
-আমার কি করার ছিল আপা বলেনতো? আমি কি জানতাম নাকি যে উনি ঐ সময়টাতেই আবার ওনার তাবিজটা নিতে আসবে?
অতঃপর সবার কথোপকথন শেষ হওয়ার অন্তর রাইসা তাঁর কথিত মামা মামীর হাতে পঞ্চাশ হাজার টাকা গুঁজে দিয়ে বলে,
-আপনারা এখন আসতে পারেন। আর যেভাবে যেভাবে বলেছি সেভাবে সেভাবেই কাজ করবেন। ভুলেও যেন ওরা আপনাকে খুঁজে না পায়।
-তুমি কোনো চিন্তা কইরোনা, মা। আমরা এখন গাড়িতে উইঠা ডাইরেক বরিশাল চইলা যামু। ওরা কেনো ওগো বাপ দাদারাও আমাদের খুঁজে পাইবোনা।
.
সবাইকে বিদায় জানিয়ে রাইসা ছদ্মবেশে নিজেদের সেই পুরোনো বাংলোর পাশে থাকা বাবা মায়ের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে দু ফোঁটা নিজের অশ্রুজল বিসর্জন দিচ্ছে। পরক্ষণেই কবরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
-মা, প্রতিশোধটা আমি নিতে পেরেছি। বাবা, তোমাদের যারা নিরপরাধে সেদিন খুন করেছিল তাঁদের একটাকেও আমি নিস্তার দেই নি বরং বাবা ছেলেসহ ওর মাকেও আমি পরকালের টিকেট ধরিয়ে দিয়েছি। আমার জন্য দোয়া করো মা, আমি তোমাদের ছেড়ে আজ দূর বহুদূর পাড়ি জমাবো। হয়তো তোমাদের কবরের পাশে আমি আর কোনোদিন আসতে পারবোনা ঠিকই কিন্তু তোমরা সব সময়েই আমার এই বুকের মাঝেই আছো এবং থাকবে।
এই বলেই রাইসা নিজের আবেগকে দমিয়ে রাখতে না পেরে হু হু করে কেঁদে দিলো। আচমকাই পেছন থেকে কেউ রাইসার কাঁধে হাত রাখাতে সে কিছুটা চমকে উঠলো বোধহয়। পেছনে তাকাতেই দেখতে পায় আজমল চাচা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের অশ্রুজল বিসর্জন দিচ্ছে। রাইসা নিজের চোখদুটো মুছে নিয়ে বললো,
-চাচা তুমি কাঁদছো কেন?
-কাঁদছি কি আর এমনিতেই? তুই কি আসলেই আমাকে, তোর ঐ মৃত বাবা মাকে ছেড়ে চলে যাবি? আমার কথাকি তোর একটুও মনে হবেনা?
-কে বলেছে তোমার কথা আমার মনে হবেনা? তুমিইতো আমাকে এতোটা বড় করে তুলেছো। আমি কি এতো সহজেই তোমাকে ভুলে যাবো? আমি আবার আসবো কোনো একদিন, আর এই বাড়িটাতো তোমাকেই দেখতে হবে তাইনাহ? আমার আর এই বাড়ির প্রতি কোনো লোভ নেই। আমি তোমার মেয়ের নামে সবকিছু লিখে দিয়েছি। আজ থেকে এটাতে তোমরাই থাকবে। আমার খুব দেড়ি হয়ে যাচ্ছে, আমি আজ আসি তবে!
এই বলেই রাইসা আর কিছু না বলে হাঁটা শুরু করলো। কিছুটা পথ আসার পর হঠাৎই সে থমকে দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো নিজের বাংলোটিতে একবার চোখ বুলিয়ে পুনরায় আবার অজানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। কিছু গল্পের সমাপ্তিটা কেমন যেন অসমাপ্তই থেকে যায়। হয়তো এটাই গল্পের সৌন্দর্য্যকে বাড়িয়ে দেয় কিংবা গল্পের পুরো সৌন্দর্য্যকেই নষ্ট করে দেয়। কিন্তু একটি কথা চিরন্তন সত্য যে প্রতিশোধপরায়ণ মানুষগুলোর হৃদয়টা ইস্পাতে মোড়ানো থাকলেও ভেতরটা কিন্তু সত্যিই নমনীয়তারও উর্ধ্বে থাকে। সেটা আপনি না বুঝলেও সৃষ্টিকর্তা ঠিকই বুঝেন, কারণ তিনিতো মহান, হ্যাঁ তিনি সত্যিই মহান।