My Heart Will Go On : Celine Dion
রোদ-শুভ্রর প্রেমকথন
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
৪২
জী-ব-ন! সবার জীবনেই একটা গল্প থাকে। কারো গল্প সুপ্ত, লুকায়িত। কারো গল্প ধ্রুবতারার মতো প্রকাশিত। খন্ড-বিখন্ড। ছড়ানো। আমার জীবনের গল্পটাও তাদেরই একটি। খন্ড-বিখন্ড। ছড়ানো-ছিটানো। হাজারখানেক চোখে এক কাল্পনিক বিস্ময়! সেই গল্পের প্রতিটি পাতায় পাতায় হাসি, আনন্দ আর আকাশসম আবদার। কিন্তু শুধু আনন্দ দিয়ে কী গল্প হয়? জীবন নামক উপন্যাসে এতো আনন্দ, এতো হাসি সহ্য হওয়ার তো কথা নয়? তাহলে আমার বেলা উল্টো কেন? প্রকৃতি বুঝি হেসেছিল। সেই হাসিতেই উল্টে গেল ডায়েরির পাতা। নীল থেকে গাঢ় নীল হয়ে এলো প্রতিটি অক্ষর। বছরের পর বছর হাসির ভেলায় ভাসতে ভাসতে বিচ্ছেদ, পরাজয়ের সমুদ্রে নোঙর ফেললাম স্ব-ইচ্ছায়। হাসির গল্পগুলো আড়াল হতে লাগল ডায়েরির সেই বন্ধ কোটরে। আমি চেয়ে দেখলাম। মৃদু হাসলাম। তারপরই হারিয়ে ফেললাম রঙ। জীবনরঙা রঙিন রঙ!
'রোদ-শুভ্রর' নিজস্ব গল্পটা যখন আনন্দের নদী পেরিয়ে গাঢ় বিষাদের সমুদ্রে নোঙর ফেলল তখন আগষ্ট মাস। গোটা বাংলায় শরৎ এর আমেজ। আকাশে পেঁজা মেঘের ভেলা। হিমঝুরি, শেফালি, শিউলিতে ভরে আছে সদ্য ভেজা উঠোন। কবিরা বুঝি গাইছিলেন উন্মাদনার গান। অবাধ্যতার ছন্দ!
''অসীম নীলে মাতাল অনিলে মেঘের তুলো ভাসে!
সবুজ দিগন্ত বন-বনান্ত প্রাণ খুলে হাসে!"
আমিও প্রাণখুলে অবাধ্য হয়ে উঠলাম তখন। চঞ্চল হয়ে উঠল মন। পড়াশোনা ছেঁড়ে-ছুঁড়ে সাময়িক আনন্দে গা ভাসালাম। যৌবনের প্রথম প্রহর, কারো বাঁধা শোনার সময় নেই। চারদিকে রঙিন শহর। রঙিন আমি'র, রঙিন স্বপ্ন। সে যায় হোক, তখন বোধহয় আগষ্টের বিশ কিংবা পঁচিশ তারিখ চলছে। বাড়িতে কেমন সাজ সাজ রব। কাজিনরা সব মামা বাড়ি ঘুরতে এসেছে। মিথি আপু মা হতে চলেছে, চারদিকে সেকি হৈ-হুল্লোড়। আমাদের কাজিন সমাজে তখন এই প্রথম বাচ্চা! আমরা সব একসাথে চাচা-মামা-খালা-ফুপু হয়ে যাব, চিন্তা করা যায়? আমার পড়াশোনা এবার লাটে উঠল। আলিফ ভাই, অদুত ভাই, মিলাদ ভাই, মিথি আপু, তনিমা আপু, চয়ন ভাইয়া, রুহি আপু, রুদ্র ভাই, রাফিয়া, জারিফ, আদিবা... উফফ! এতোগুলো মানুষ একসাথে হৈচৈ করছে। আনন্দ করছে। আর আমি বইয়ের পাতায় মুখ ডুবিয়ে বসে থাকব? অসম্ভব! এক্কেবারে অসম্ভব। কিন্তু আড্ডার মধ্যমণি, শুভ্র ভাই আপত্তি তুললেন। তার আমাকে নিয়ে বিশাল সমস্যা। তিনি কোনোভাবেই আমায় আড্ডায় বসতে দিবেন না। আড্ডায় বসতে হলে বিশের ঘর ছুঁতে হবে। দলভেদে গরম গরম গল্প চলবে। আমাদের মতো শিশুদের নিয়ে পান্তাভাত গল্প চলবে না। সুতরাং নট এলাউড। আমি আর রাফিয়া অসহায় চোখে চাইলাম। মুখ ফুলিয়ে বললাম,
' আমার বয়স উনিশ বছর সাত মাস সতেরো দিন। অলমোস্ট টোয়েন্টি। চার মাস পর তো বিশ হয়েই যাব। চার মাসের জন্য কী এমন হলো?'
শুভ্র ভাই তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন। গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
' বিশ বছর পূর্ণ হওয়ার এক সেকেন্ড আগেও যেখানে আড্ডায় নেওয়া যাবে না। সেখানে তুই চারমাস তেরো দিনকে মাত্র বলে ফেললি? চার মাস তেরো দিন মানে বুঝিস তুই? চারমাস তেরো দিন মানে হলো, এগারো কোটি চার লক্ষ একানব্বই হাজার দুইশো সেকেন্ড! আমি একজন দায়িত্ববান নাগরিক হয়ে এসব দূর্নীতি বরদাস্ত করব না। ফুট! '
আমি হতাশ হলাম। মুখ ফুলিয়ে বললাম,
' কী এমন গল্প করবেন যে বিশ বছর না হলে শোনা যাবে না? আমি এক্ষুনি আম্মুকে গিয়ে বলব আপনারা ছাদে বসে অশ্লীল গল্প করছেন।'
আমার কথায় শুভ্র ভাইয়ের কোনো ভাবান্তর হলো না। তিনি ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে বললেন,
' বল গে যা। মানা করেছে কে? তোর বাপকেও বলিস। আমরাও বলব তুই এইসব অশ্লীল গল্প শোনার জন্যই মরে যাচ্ছিস!'
আমি চোখ বড় বড় করে চাইলাম। আমি অশ্লীল গল্প শোনার জন্য মরে যাচ্ছি? আমি! আমি চোখ-মুখ লাল করে চুপ করে বসে রইলাম। এই লোকের সাথে তর্কে জড়ানো মানেই যন্ত্রণা। চড়-থাপ্পড় খাওয়ার সমূহ সম্ভবনা। আমাদের এমন আঠার মতো চিপকে বসে থাকতে দেখে হা-হুতাশ করে উঠলেন আলিফ ভাই। অধৈর্য হয়ে বললেন,
' উফ! এমনে আঠার মতো বসিস আছিস কেন? যা না? আমার এই মুহূর্তে একটা কথা মনে পড়েছে। ভেরি ইম্পোর্টেন্ট। পেট ফেঁটে যাচ্ছে, না বললে শান্তি পাচ্ছি না। তোদের সামনে বলা যাবে না। যা ফুট! ভাইদের আড্ডায় তোদের কী কাজ?'
আলিফ ভাইয়ের অধৈর্য বার্তা শুনে আগ্রহ নামক প্রজাপতিটা আকাশে বাতাসে দুলতে লাগল। 'না বলে শান্তি পাচ্ছি না', টাইপ কথাটা না শুনেই উঠে যাওয়াটা একরকম অসম্ভব হয়ে গেল। মাথার টু-জি স্পিডের মস্তিষ্কটা ছুটতে লাগল দ্রুত। রাফিয়া নাছোড়বান্দার মতো বলল,
' এটা ভাইদের আড্ডা হলে রুহি আপু, তনিমা আপু, মিথি আপু, আদিবা ওরা এখানে কেন? ওরা বুঝি বোন না? তোমরা সবসময় আমাদের সাথে শত্রুতা করো। এটা কিন্তু ঠিক না।'
রুদ্র ভাই খেঁক করে উঠে বলল,
' মারবো এক চড়। তোর না পরীক্ষা? যা গিয়ে পড়তে বস। নয়তো আম্মাকে ডেকে বলব তুই এখানে বসে ঢং করছিস। ঢঙী মাইয়া।'
রাফিয়া ফুঁসে উঠে বলল,
' আসছে আম্মার চামচা। যা গিয়ে বল। আমিও আব্বাকে বলব, তুই আব্বার পকেট থেকে টাকা সরিয়ে মেয়ে নিয়ে জয়নুল আবেদীন যাস। আমি দেখেছি।'
রুদ্র ভাই থমকে গেল। বোনের আসন্ন বিজয়ে কালো হয়ে গেল মুখ। রুদ্র ভাইয়ের ফ্যাকাশে মুখ দেখে হুহা করে হেসে উঠল সবাই। আলিফ ভাই বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকাল। রাফিয়ার দিকে ঝুঁকে ভীষণ খুশি খুশি কন্ঠে বলল,
' এই রাফু? মেয়েটা কে রে? নতুন নাকি এক্সপায়ার্ড?'
আলিফ ভাইয়ের আগ্রহ দেখে খুশিতে ঝুমঝুম করে উঠল রাফিয়া। আড্ডায় ডুকে যাওয়ার সমূহ সম্ভবনায় ঝলমল করে উঠল মুখ। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। রাফিয়া কিছু বলার আগেই সর্বশেষ যুদ্ধ চুক্তি ছুঁড়ে দিলেন শুভ্র ভাই। গম্ভীরমুখে বললেন,
' মেয়েটা কে ছিল তা নিয়ে আমাদের আগ্রহ নেই। রোদু দ্য ছকিনার মা এখানে থাকলে কোনো কিছুতেই আগ্রহ আমাদের থাকবে না। হাঁটুর বয়সের কাউকে আমরা আড্ডা ফাড্ডায় নিব না। রোদু থাকলে আমি থাকব না। আড্ডা সমাপ্ত।'
শুভ্র ভাইয়ের ঘোষণায় পুরো কাজিন গ্যাং-এ এক রকম হৈ হৈ পড়ে গেল। সবাই চোখ বড় বড় করে আমার আর রাফিয়ার দিকে তাকাল। ভাবখানা এই, শুভ্র ভাই দ্য গ্রেট ছাড়া আড্ডা জমা অসম্ভব। দরকার পড়লে দশখানা রোদকে বনবাস দাও তবু শুভ্র দ্য গ্রেটকে প্রশংসিত করো। মীরজাফর ভাই-বোন। আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
' খবরদার আমায় ছকিনার মা বলবেন না!'
শুভ্র ভাই যেন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। একরকম বাক্যহারা হয়ে বললেন,
' তুই আমাকে ধমক দিস! আমাকে? কত বড় বেয়াদব? তোর মতো বেয়াদবের জন্যই দেশটা এমন রসাতলে যাচ্ছে। বড়দের প্রতি কোনো রেস্পেক্ট নেই? তোর যে হাঁটুর সাইজের বয়স। তোর তো উঠতে বসতে আমায় সালাম দেওয়া উচিত। বল, আসসালামু আলাইকুম।'
আমি চোখ-মুখ ফুলিয়ে চুপ করে বসে রইলাম। আলিফ ভাই অসহায় কন্ঠে বললেন,