জন্ম আমার নবীর যুগে হলে কেমন হতো Jonmo Amar Nobir Juge Hole Kemon Hoto |...
ছাঁদে বসে আম্মুর আঁচার দেওয়া দেখছিলাম,তখনই কোথার থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলো আব্বু।হাতে কিছু শপিংব্যাগ আর কাঁচাবাজারের থলে নিয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আম্মুর উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
“বড়ভাই আসছে আজকে বাসায়,এই বাজারগুলো নিয়ে তারাতারি যাও রান্না বসাও হয়তো আর ঘন্টা তিনেক এর মধ্যে চলে আসবে।”
আম্মু অবাক চোখে কতক্ষন তাকিয়ে থেকে বাজারের ব্যাগটা আব্বুর হাতের থেকে নিয়ে ছুট দিলো রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে।এবার আমার দিকে তাকিয়ে বাবা কিছুটা করুণ স্বরেই বললেন,
“বাসায় আজকে যাইহোক না কেন তুমি একটি কথাও বলবে না।তাছারা তোমার চাচাতো বোনরাও আসছে তাই আগে থেকে বলে রাখছি,প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে একপাও বের হবে না।”
কথাগুলো মনে হলো আব্বু খুব কষ্ট করে বললো আমার উদ্দেশ্যে।আমিও কথা বাড়ালাম না কোন প্রকারের,কী দরকার শুধু শুধু তাদের ভুলগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে?তারাও তো মানুষ তাদেরও যে ভুল হবে এইটাই তো স্বাভাবিক।
বড়চাচা বাসায় ঢূকেই বাবার সাথে কিছু বিষয় নিয়ে কথা বললো তারপর আমার সন্ধানে আমার চাচাতো বোন রাইসাকে পাঠালো আমার রুমে।আমার রুমটা মূল বাসা থেকে আলাদা করে নিয়েছি আমি বছর চারেক আগে,যেদিন থেকে আমার ছোট বোনের মৃত্যু হয়েছে।আমার রুমটা বাগানের এক সাইডে আমার বোনের কবরের পাশেই।এই পাশটায় আম্মু আর রাইসা ছাড়া আর কারো প্রবেশের অনুমতি নেই সেইটা আমার পরিবারের সবাই জানে,তাই রাইসাকেই পাঠিয়েছে বাধ্য হয়ে।আমার দরজার সামনে এসে রাইসা প্রথমে পাশের কবরটার দিকে তাকিয়ে চোখের পানি মুছলো,তারপর আমার রুমে সটাং করে ঢুকে দরজা আটকে দিলো।আমি জানালা দিয়ে দেখছিলাম বাইরের দৃশ্য।এইবার আমার দিকে তাকিয়ে রাইসা’ই বলে উঠলো,
“কেমন আছো ভাইয়া?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি আমি,তুই কেমন আছিস?”
“তোমাকে দেখে এখন ভালো লাগছে।বাসার বাইরে যাও না কতদিন?”
“প্রতিদিনই তো অফিসে যাচ্ছি,কেন আম্মু তোকে বলেনি?”
“না চাচীর সাথে অনেকদিন কথা হয়নি,এখানে এসে অবধি দেখাও হয়নি এখনো।”
“ভালো কথা তোর মেয়ে কই?ওকে তো দেখছি না।আমার কাছে নিয়ে আসবি না নাকি?”
“না এনেছি ওকে।ও বাগানে বসে তোমার খরগোশগুলোর সাথে খেলা করছে।আর ওকে দেখতে হলে তোমাকে নিজে থেকেই ওর কাছে যেতে হবে।ও আসার আগেই বলে দিয়েছে যদি নিজে থেকে তুমি ওকে তোমার কাছে ডাকো তাহলেই আসবে ও নতুবা নয়।”
আমি হালকা হেসে রাইসাকে সাথে নিয়েই রুম থেকে বের হলাম,দেখতে পেলাম একটু দুরেই মায়া বসে আছে খরগোশগুলোর মাঝে।মায়ার বয়স সাড়ে চার বছর কিন্তু এক-একটা কথা শুনে মনে হয় যেন বয়স্ক কোন মহিলা তার লজিক দিয়ে নাতি-নাতনীদের কল্পকাহিনী বোঝাচ্ছেন।আমি কাছে যেতেই আমাকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে বলতে লাগলো,
“আমাল এততা মামা আতে তিন্তু সে আল আমাল থাতে তথা বলে না,এতে আমি দে ততো তততো পাই তা তী সে দানে?আমি তাল উপল অনেত লাগ তলেথি”(আমার একটা মামা আছে কিন্তু সে আর আমার সাথে কথা বলে না,এতে আমি যে কতো কষ্ট পাই তা কী সে জানে?আমি তার উপর অনেক রাগ করেছি)
“আমি খুবই সরি মাম্মাম,আসো আমার কোলে আসো।আজকে তুমি আর আমি অনেকখন ধরে কানামাছি খেলবো কেমন?তাহলে কী আমাকে মাফ করা যাবে?”
মায়া খিলখিল করে হেসে আমার কোলে উঠে পরলো।আমিও আর দেরী না করে ভেতর বাসার দিকে রওনা দিলাম।
বড়চাচা আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলো,আমাকে দেখতে পেরেই দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি।এরপর রাইসা কে ইশারা করে বললো মায়া কে নিয়ে ভিতরে যেতে।আমি বুঝতে পেরে মায়াকে বললাম,
“মাম্মাম আমি একটু পরে আসছি তুমি গিয়ে খেয়ে নেও কেমন।তারপর তুমি আর আমি দুজনে কানামাছি খেলবো ঠিক আছে”
মায়া হুম বলে মাথা দুপাশে নাড়িয়ে আমার গালে একটা চুমু দিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেল।মায়া যেতেই চাচা বলে উঠলেন,
“দেখো যা হয়েছে তা নিয়ে আমরা সবাই খুবই কষ্ট পেয়েছি কিন্তু তা বলে যে এইভাবে যে তুমি আমাদের ভুল বুঝবে তা কিন্তু উচিত নয়।তোমার বোনের মৃত্যুতে তুমি তোমার বাবা আর আমাকে যেইভাবে দায়ী করছো তাতে মনে হচ্ছে যেন আমরাই ওকে মেরে ফেলেছি।বাস্তবতায় ফিরে এসো,আমাদের তখন কিছুই করার ছিলো না”
“কিছুই করার ছিলো না আপনাদের?”
কথাটা শুনে চাচা মাথা নিচু করে ফেললো।আমার চোখের সামনে যেন ৪ বছর আগের ঘটনাগুলো ভেসে উঠতে লাগলো বারবার…….
………………………………চার বছর আগে………………………………….
আমি তখন কানাডায় গ্রাজুয়েশন এর জন্য আটকে আছি।রাইসা আর আমি অল্পকিছুদিনের বড়-ছোট।তাই ওখানেই রাইসা আর ওর হাসবেন্ডের সাথে থাকছি।দেশেও আসতে পারছিলাম না রাইসার প্রেগ্নেনসির জন্য,ওর হাসবেন্ড ওখানকার একটা মেডিসিন রিসার্চ ফ্যাসিলিটির হেড তাই রাইসাকে সময় দিতে পারছিলো না তাছাড়া রাইসার পাশে সবসময় কাউকে দরকার,যেকোন ডেটে ডেলিভারী হবে।এইদিকে দেশে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো আমার ছোট বোন ফারিহা।সদ্য কলেজে ভর্তি হয়েছিলো সে,তখনই একদিন খবর পেলাম ফারিহা অসুস্থ।আমি রাইসাকে ফেলে সেদিনই বাংলাদেশে রওনা হলাম।রাইসাই একপ্রকার আমাকে জোর করে পাঠালো কিন্তু দেশে এসে জানতে পারলাম আমার বোন আর পৃথিবীতে নেই।আমি এই হঠাৎ পাওয়া শক সহ্য করতে না পেরে ব্রেইন স্ট্রোক করলাম।প্রায় মাস ছয়েক হাসপাতালে থেকে এরপর বাড়ীতে ফিরলাম।বাড়ীতে ফেরার পর জানতে পা্রলাম সবই।
ফারিহা ক্লাস ৯ এ থাকতে ওর জন্য বাসায় একজন শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়া হলো,ছেলেটাকে বড়চাচা কোথা থেকে নিয়ে এসেছিলো তা আব্বু আর চাচা জানতো।আমাকে জানানো হয়নি কারণ আমি ফারিহাকে পড়ানোর জন্য সবসময় মহিলা শিক্ষক নিয়োগ দিতাম কিন্তু একটা ছেলেকে বাসায় টিউটর রেখেছে জানলে আমি ঝামেলা করবো মনে করেই তারা বিষয়টাকে আমার থেকে গোপন রেখেছিল।প্রথম মাসখানেক সব ভালোই চলছিলো,এরপর আস্তে আস্তে ছেলেটার প্রতি ফারিহা দুর্বল হয়ে পরে,এবং একসময় প্রেমের সম্পর্কে লিপ্ত হয়ে পড়ে।বিষয়টা আরো খারাপ পর্যায়ে চলে যায় যখন ফারিহার এসএসসি পরিক্ষা চলে আসলো কারণ ততদিনে ফারিহা খুবই খারাপভাবে সেই ছেলের ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছিলো।বিষয়টা বাসায় জানাজানি হতেই প্রচুর মানসিক ও শারীরিক ভাবে ফারিহাকে অত্যাচার করা শুরু হয়ে যায়।এমন কোনদিন ছিলোনা যেদিন আমার বোনটাকে বড়চাচা বা আব্বুর হাতে লাঞ্চিত হতে হয়নি।এই কথাগুলো সে আমাকে জানায়নি কারণ আমি জানতে পারলে যে আব্বু বা চাচা কেউই আমার হাত থেকে রেহাই পাবে না সেইটা সে জানতো।বাসার অন্য সবাইকে বাঁচাতে গিয়ে সে ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করলো।সেইসময় চাচা ফারিহার জন্য হঠাৎ করে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেন আর বাবাকে ভুজুম্ভাজুম বুঝিয়ে রাজী করিয়ে ফেলে।মা আমাকে জানিয়ে দিতে চেয়েছিলো বলে মাকে হুমকি দিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়।এবং এর কিছুদিনের মধ্যেই ফারিহার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়।যার সাথে বিয়ে হয় সে পেশায় কলেজের শিক্ষক ছিলো বলেই ফারিহাকে লেখাপড়ায় বাধা দেয়নি কিন্তু শারীরিক অত্যাচার এর মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।অবশেষে ফারিহা নিজে থেকেই আত্মহত্যা করে এই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে।
…………………………………বর্তমান……..…………………………….
সোফায় বড়চাচা আর বাবা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে,আমি কোলে ঘুমন্ত মায়াকে নিয়ে বসে আছি পাশেই রাইসা ঘুমিয়ে পড়েছে কান্না করতে করতে।এইবার আমি চাচার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে বসলাম,
“আপনারা দুই ভাই মিলে আমার বোনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেন,কিন্তু কেন?ও কি এমন করেছিল বলুন আমাকে।ওর বয়সে আপনার নিজের মেয়েও তো এমন প্রেম করে বেরিয়েছে তখন কোন সমস্যা হয়নি তাহলে ফারিহাকেই কেনো এইসবের মুখোমুখি হতে হলো বলুন আমাকে?”
চাচা ধীর গলায় বলে উঠল,
“ফারিহা ২ মাসের অন্তঃসত্তা ছিলো,বিষয়টা জানাজানি হলে আমাদের ফ্যামিলির মানসম্মান সব নষ্ট হয়ে যেত তাই জানাজানি হবার আগেই তোর বাবাকে বুঝিয়ে ফারিহার বিয়ের ব্যাবস্থা করেছিলাম।ভেবেছিলাম বিষয়টা ছেলেপক্ষ টের পাবে না কিন্তু হিতে-বিপরীত হয়ে গিয়েছিলো।ফারিহার এবোরশন করানোর কোন উপায় ছিলোনা আর সেই টিউটোর ছেলেটাও গায়েব হয়ে গিয়েছিলো তাই বাধ্য হয়েই বিয়েটা দিয়ে দেই।”
আমি নিশ্চুপ হয়ে বসেছিলাম এতোক্ষন,এবার বাবার উদ্দেশ্যে এই চার বছর পর প্রথম বলতে শুরু করলাম,
“আপনি মানসিক ভাবে সারাজীবন ধরেই দুর্বল তাই আপনার ভাই সারাজীবন যা বলেছে তাই শুনেছেন,কিন্তু নিজের সন্তা্নদের ভালো-মন্দের বিচার করার ক্ষমতাও যে আপনার ছিলো না তা আমি জানতাম না।ভাগ্যিস আজ আমার আর কোন ভাই-বোন নেই,থাকলে হয়তো তাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার জন্য হলেও আমাকে এই নরকে থেকে যেতে হতো।তবে আল্লাহ এতোটা কষ্ট আমাকে দিতে চাননি বোধহয় তাই এই যাত্রায় বেঁচে গেলাম।আর হ্যাঁ আপনার সাথে আমার আজ এখানেই শেষদেখা হচ্ছে এইটা মাথায় ঢূকিয়ে নিন।আসি আসসালামু আলাইকুম”
…………………………………………………………………………………………………………লাগেজ আর ব্যাগপত্র গাড়ী থেকে নামাচ্ছি তখন মায়া বলে উঠল,
“মামা তুমি তি আল আসবে না আমাল তাতে?”(মামা তুমি কি আর আসবে না আমার কাছে?)
“আসবো মাম্মাম,তুমি একটু বড় হও তখন তোমাকে একেবারে আমার কাছে নিয়ে যাবো কেমন।”
এইবার রাইসাকে উদ্দেশ্যে করে বললাম,
“যদি কখনো মনে হয় তোর সন্তানের জন্য নেওয়া কোন সিদ্ধান্ত তোর মনে ভালো ঠেকছে না তাহলে অন্যকিছু ভাববি,প্রয়োজন পরলে বাচ্চাদের সাথে শেয়ার করবি তাও বাইরের কারো কাছে সাহায্য চাইবি না,নাহলে আজ ফারিহা যেই পথে গিয়েছে তোর মেয়েও সেই পথেই যাবে।”
ইমিগ্রেশনের অপেক্ষায় বসে বসে ভাবছিলাম,আজ যদি বাবা আর চাচা ওই ভুল সিদ্ধান্তগুলো না নিতেন তাহলে হয়তো এইসব কিছুই হতো না এবং ফারিহাও বেঁচে থাকতো আর শুধু শুধু আমাকে এতোগুলো মানুষের জন্য টিকিট হতো না।কিন্তু বাস্তবতা বড়ই ভিন্য, হয়তো আগামীকালকের খবরে শোনা যাবে যে শহরের এক নির্জন প্রান্তে অজ্ঞ্যাত চারটি লাশ পাওয়া গিয়েছে,পরিচয় খুজলে হয়তো জানা যাবে একজন ছিলেন পেশায় কলেজ শিক্ষক অন্যজন ছিলো পেশায় গৃহশিক্ষক বাকি দুইজন ছিলেন আপন মায়ের পেটের দুই ভাই।”
………………………………..সমাপ্ত………………………………
#হয়তো_এইসব_কিছুই_হতোনা
লেখনীতেঃ H.M. Rafit