Eid Telefilm : Batch 27 | Apurba, Mithila, Aparna by Mizanur Rahman Aryan বাংলা নাটক ব্যাচ ২৭
বাংলা নাটক ব্যাচ ২৭ Eid Telefilm : Batch 27 | Apurba, Mithila, Aparna by Mizanur Rahman Aryanএই বাড়িতে যখন প্রথম বউ হয়ে আসি, দুইজন মানুষকে আমার একদমই সহ্য হতো না তারমধ্যে একজন আমার স্বামী, অন্যজন আমার শাশুড়ী। আর এই বাড়ির অন্য তিন বউকে আমার মানুষই মনে হতো না। সত্যি বলতে কি, তাদের দেখে আমার মায়া হতো। আমি এই বাড়ির সর্বশেষ বউ। আমার বড় তিন জা, এদের সবার স্বামীই প্রবাসী। এখনো এই ভাইদের দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। শুধু আমার সাহেবই দেশে বিজনেস করেন। সবার ছোট ছেলে হওয়াতে আমার শাশুড়ী উনাকে নিজের থেকে দূরে রাখতে চাননি। আমার স্বামীর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন আমার শ্বশুর দুনিয়ায় মায়া ত্যাগ করে আল্লাহর ডাকে সাড়া দেন। তখন থেকেই আমার শাশুড়ী একলা হাতে এই ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের বড় করে তোলেন। সব বাচ্চারাই ১৫ বছরের কম বয়সী ছিল। শত কষ্টের পরও এই অপূর্ব সুন্দরী বিধবা মহিলাটি সন্তানদের ইন্টার পর্যন্ত পড়ালেখা করিয়েছেন। এমনকি দুই মেয়ে সন্তাদেরও পিছিয়ে রাখেননি।
উনার ব্যপারে জেনে প্রথমেই উনার প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে এসেছিল। যখন এই বাড়িতে আসি সেই শ্রদ্ধা ঘৃণায় রুপ নিতে সময় নেয়নি। মনে হতো কোন মা এত কঠোর কীভাবে হতে পারে?! একমাত্র আমার সাহেবই উচ্চ শিক্ষিত। এবং দেশে বিজনেস করেন। ভাইদের টাকায় বিজনেস করে দেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। এখন উনি বিজনেসের ব্যপারে আবেগহীন পাক্কা একজন ব্যবসায়ী।
তবে এদের মধ্যে একটা জিনিস বেশ ভাল লাগে, এরা ভাইয়ে ভাইয়ে প্রচন্ড মিল। একে অপরকে নিস্বার্থভাবে ভালবাসে। একে অপরের মতামতকে খুবই মূল্যায়ন করে। সবচেয়ে বেশি মূল্যায়ন করে আমার শাশুড়ীর মতামতকে। বলা যায় উনার কথার উপর একচুল পরিমাণও নিজের মত প্রকাশ করেন না। উনি সাপকে ব্যাঙ বললে ওরাও বিনাবাক্য ব্যয়ে মেনে নিবে! আর এই জিনিসটাই আমার একদমই অসহ্যের।
উনাদের বাড়িটা উপজেলা ভিত্তিক যে শহরগুলো হয় না? প্রায়ই শহরের ছোঁয়া লেগেছে কিন্তু আশেপাশের গ্রামীণ পরিবেশ শহরটাকে অনেক বেশি সুন্দর করে তোলেছে। এই বাড়িটা আমার কাছে আরেক অদ্ভুত মনে হয়! বিশাল বড় বাউন্ডারি! কী নেই এতে, মাঝারি সাইজের পুকুর, পুকুরের চারপাশে বেশ উঁচু বাউন্ডারি ওয়াল। পুকুরের পাড়ে নানা রকমের ফলের গাছ, সেখানে আপেল, আঙুর, কমলা, ডালিম, সফেদা থেকে শুরু করে নানা দেশি-বিদেশি ফলে সবসময় পূর্ণ। আর এই পুকুরের বাউন্ডারিতে শুধমাত্র বাগান পরিচর্যাকারী ছাড়া বাইরের সব পুরুষ সদস্যের প্রবেশ নিষিদ্ধ। এই এক আজব বিষয়! তবে সব বউরা যখন খুশি পুকুরে যেতে পারবে। উঠানের এককোণেয় লোহার বড় এক দোলনা, যেখানে অনায়াসে দুইজন মানুষ আরাম করে শুইতে পারবে। কয়েকটা সাইকেল, প্রথম দেখেই আমার মনে হয়েছিল এখানে বড় সাইকেল চালানোর মত কেউ নেই তবে এত সাইকেল কেন?
আমার খুব বিরক্ত লাগে, শহরে নিজেদের বিশাল বড় বাড়ি থাকার পরও এরা কেন গ্রামে পরে থাকে। তবে শহরের সব সুযোগ সুবিধাও ভোগ করে। নিজেদের গাড়ি ছাড়া কোথাও যায় না। দুই বাড়িই খুব আধুনিকভাবেই তৈরি করেছে। শুনেছি বড় ভাইরা বিদেশের সিস্টেমেই সব কিছু করেছেন।
আর আমি অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়া অবস্থায়ই বাবা আমার পড়ালেখার, আমার মতামতের কোন তোয়াক্কা না করে এই বাড়িতে আমার বিয়ে ঠিক করেন। আমার সাহেবের সাথে বাবার অনেক আগে থেকেই ভাল সম্পর্ক। ব্যবসার দিক দিয়েই এদের পরিচয়।
এই বাড়িতে আসার পর থেকেই শুধু বাবার উপর প্রচণ্ড রাগ হতো। কেন বাবা এমন করলেন? এমনিতেই বাবা খুব শান্ত মানুষ। মায়ের কথার বাইরে কথা বলেন না। কিন্তু আমার বিয়ের ব্যপারে বাবা এত দৃঢ় কীভাবে হলেন বুঝে আসে না। মায়ের কোন কথা শুনেননি। এমনকি মাকে কয়েকবার এমনভাবে বকা দিয়েছেন আমার গরম মেজাজের মা চুপ করে থাকতে বাধ্য হয়েছে। হয়তো এই নতুন রুপটি মাকে বেশ অবাক করেছিল। যেমন আমরা সবাইও অবাক হয়েছিলাম।
এই বাড়ির তিন বউয়ের পাঁচটা সন্তান। দুই বছরের ছোট বাচ্চাটিসহ বাড়ির সবাই ফজরের আজানের সাথেসাথেই ঘুম থেকে জেগে যায়। পাঁচ বছরের ছোট বাচ্চাটিরও নামাজ পড়তেই হবে কোরান শেখা শুরু করেনি কিন্তু মায়ের সাথে মুখে মুখে দোয়া পড়তেই হবে। এশার নামাজ পড়ে রাতের খাবারের পরপরই সবার কেমনে ঘুম আসে আমি বুঝতে পারি না। আমার খুব রাগ হয়, আমার সারারাত ঘুম আসে না, আমার ঘুম আসার টাইমেই এরা জেগে যায়। আমার সারাদিন খুবই বিরক্তিতে দিন কাটতো। দুপুরে একটু ঘুমুতে পারতাম তাও দেড়/দুই ঘণ্টা আসরের আজানের সাথেসাথে সবাই উঠে যাবে। উফ্! এত কষ্ট অসহ্য। আমার জা'দের দেখলে মনে হয় এরা আমার শাশুড়ীর ভয়ে এমন; না কি এরা স্বাভাবগতপভাবেই এমন৷ বাড়ির যে কোন কাজ এরা কার আগে কে করবে ভেবে পায় না। বুয়াও আছে, আবার পার্মানেন্ট কাজের মেয়েও আছে। তাও শাশুড়ী গোসল করার পর এরা কার আগে কে শাশুড়ীর কাপড় ধুয়ে দিবে প্রতিযোগিতা করে।
আমার মাঝেমাঝে মনে হয় আল্লাহ এদের হিংসা, ঈর্ষা ছাড়াই বোধহয় দুনিয়েতে পাঠিয়েছেন।আর আমার স্বামী, সে রুমের ভেতর খুব খুব ভাল একজন স্বামী। খুব হেল্পফুল, কেয়ারিং, লাভিং, আমাকে ছোট বাচ্চাদের মত স্নেহ করেন, ভালোবাসেন, বুকের গভীরে আগলে রাখতে চান।সবসময় একটা কথা বলেন, প্লীজ সুমাইয়া, মায়ের অবাধ্য হয়ও না। মা আমাদের বহু কষ্টে বড় করেছেন। কিন্তু রুমের বাইরে আসলেই সে অন্য মানুষ। আমার রাগ হতো কেন সে আমার সাপোর্টে কিছু বলতে পারে না? আমি বাবার বাড়ি যেতে চাই! কিন্তু না, নির্দিষ্ট সময় না হলে যেতে পারব না। একবারে একটা বউ বাবার বাড়ি যেতে পারবে। দশ দিন থেকে আসার পর অন্য বউ যেতে পারবে সিরিয়াল করে। কী অদ্ভুদ!কারো যেতে ইচ্ছে হলেও যেতে পারবে না।
বিয়ের এক মাসের মাথায় সেদিন তো আমার আশ্চর্যের চরম সীমা পার হয়ে গেছে! রাতে নামাজের পর বাচ্চারা যখন ঘুমিয়ে গেল শাশুড়ী বললেন,--অহ বউ, তোমরা সবাই একটু সাজুগুজু করতো, সবাই শাড়ি পর। দেখলাম, সব বউ খুশি মনেই সাজুগুজু করতে চলে গেল। আমার আশ্চর্যের ঠেলা সামলাতে সময় লাগছিল বলে দেরী হচ্ছিলো শাশুড়ী আবার বললেন, মা'রে আমার ইয়াসির বাসায় আছে তাই সাজতে বেলছিলাম, যদি তোমার সাজতে ইচ্ছে না করে না সাজ সমস্যা নেই।
আমি এমনিতেই সাজুগুজু করতে ভালোবাসি। কিন্তু এই মহিলার কথার বিরুধীতা করার জন্যই আমি না সেজে সোজা রুমে চলে গেলাম। একটা জিনিস মাথায় ঢুকছে না, আমার না হয় ইয়াসির বাসায় আছে বলেই সাজতে বললেন কিন্তু সব ভাবীদের কেন সাজতে হবে!? যার উত্তর জানলাম পরেরদিন ওরা সবাই রাতে জামাইদের সাথে ভিডিও কলে কথা বলে। এর পরে প্রায়ই দেখতাম ওরা রাতে সাজতেছে।
সেদিন আমার বড় জায়ের ছেলেটা প্রি-পোজিশনের ব্যবহারে কিছু ভুল এক্সাম্পল পড়ছিলো, আমি পাশেই ছিলাম আমি তার ভুলটা ধরিয়ে দিয়ে কী এক মহা বিপদ ডেকে এনেছি!শাশুড়ী বললেন,- সেমাইয়া আজ থেকে তুমিই টাইম করে এদের তিনজনকে পড়াবে৷
উফ! কী যে অসহ্য লাগছিলো কথাগুলো! উনার সামনে তো কিছুই বলতে পারিনি কিন্তু রুমে গিয়ে ইয়াসিরের সাথে অনেক ঝগড়া করি। ওকে এত এত কথা শুনিয়েছি, সে পালটা একটা কথাও বলেনি। আমার এত এত তীর্যক কথার বিনিময়ে আমার আরো ভালোভাসাই ভরিয়া দিয়ে একটা কথাই বলেছিল,-- সুমাইয়া মায়ের কথা শুনে দেখ না, হয়তো তোমার ভালই লাগবে।
: আমার ভালো লাগবে না। তোমার সব ভাবিদের উপর যেমন চাপিয়ে দিয়েছে সবকিছু তেমনি আমাকেও তাই করতে বলছে।--তুমি ভুল বুঝছ, মায়ের দেওয়া দায়িত্ব পালনে ভাবিদের কখনো বিরক্ত হতে দেখেছ? তারা বরং খুব হাসি মুখেই সব দায়িত্ব পালন করে।তা ঠিক তারা কখনো বিরক্ত হন না। এমন নয় যে খুশি হওয়ার ভান ধরে। সত্যিকারভাবে খুশি হয়েই ওরা শাশুড়ীর প্রতি দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু ইয়াসির কীভাবে জানলো? সে তো কখনো ভাবীদের চেহারাও দেখেনি!এই বাড়ির আরেকটা খুবই আজব নিয়ম, একটা মাত্র পুরুষ মানুষ কিন্তু তার সামনে কেউ যায় না শুধু শাশুড়ী ছাড়া। টেবিলে খাবার দিয়ে সবাই আড়ালে চলে যায়। অবশ্য এই নিয়মটা আমার ভালই লাগে। যদি ইয়াসির ওর সুন্দরী ভাবীদের সাথে ঠাট্টা -মসকরা করতো আমার ভাল লাগতো না।
যাক, শুধুমাত্র ইয়াসিরের কথা রাখার জন্য বাচ্চাদের পড়ানো শুরু করলাম। তিনজনকে তিন টাইমে পড়াই। আগের টিচারকে বিধায় করা হয়েছে। প্রথম দিকে ওদের পড়াতে ভালো না লাগলেও আস্তে আস্তে বেশ ভাল লাগতো। বাচ্চা৷ তিনটাই অতি ব্রিলিয়ান্ট। বাচ্চাদের তিন টাইম পড়াইয়ে আমি খুব ক্লান্ত হয়ে যেতাম ঘরের কাজ করতে কিছুতেই মন চাইত না। তাও শাশুড়ী ভয়ে কাজ করতে গেলাম। এমনিতেই বড় জা, আমার কাছ থেকে ঝাড়ু কেড়ে নিয়ে বললো,-- তোমার কোন কাজ করতে হবে না, এটা মায়ের আদেশ।
সাথে মা রুম থেকে বলে উঠলো,: হ্যা রে বউ, তোমার কাজের চিন্তা করতে হবে না। তুমি মানুষ না কি। কত কষ্ট কর আমার নাতিদের জন্য। আবার কাজও। না মা আমি অতটাও খারাপ নই।
মনে হলো প্রথমবারই এই মহিলাকে একটু ভাল মনে হলো। যাক কাজ থেকে তো মুক্তি পেলাম। তারউপর এমন ট্রিট পেতাম নিজেকে রাজকুমারী মনে হতো। যেহেতু কাজ করতে হয় না নিজের পড়ালেখার পাশাপাশি এদের পড়াতেও আরো একটু মনোযোগী হলাম। পড়ার কিছুদিন পর, সম্ভবত এক মাস পর আমি এত বেশি অবাক হয়েছি আমি কয়েকটা হার্টবিট বোধহয় মিস করে গেলাম। আমার শাশুড়ী আমার হাতে আট হাজার টাকাসহ এক খাম তুলে দিয়ে বললেন,: আগের মাস্টারকে সাত হাজার দিতাম তোমাকে একহাজার বাড়িয়ে দিলাম কারণ তুমি আমার নাতিদের অনেক আদর করে পড়াও। তাছাড়া খুব কষ্ট করে নিজের পড়ার পাশাপাশি এদের পড়াও।
আমি কখনো ভাবিনি এদের পড়াইয়ে টাকা নিব। আমি বাচ্চাদের ভালোবাসি। ওরা যখন ছোট আম্মু করে করে পাগল করে তুলে আমার বেশ ভাল লাগে। শাশুড়ীকে বললাম : না মা, আমার টাকা লাগবে না, আপনার ছেলে আমাকে কোন কিছুর কমতি রাখেনি, না চাইতেই আমার হাতখরচ দিয়ে দেয়। --রাখ বউ মা, এটা তোমার কষ্টের ফসল আর তোমার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা।না নিলে আমি কষ্ট পাব।
না চাইতেও নিলাম। কিন্তু এক অন্যরকম তৃপ্তি পেলাম। জীবনে প্রথম নিজের উপার্জনের টাকা। মনে আসলো, উনি বোধহয় সব বউদেরই কোন না কোন ভাবে এভাবে পুরুস্কৃত করেন। হয়তো তাই উনার বউরা কোন কিছুতে বিরক্ত হয় না।
এর কিছুদিন পরেই আমার পরীক্ষা, আমি ইয়াসিরকে নিয়ে বাবার বাড়িতে চলে গেলাম। এত এত আনন্দ লাগছিলো। অনেকদিন পরেই বাবার বাড়িতে একটু আনন্দ করে বেশিদিন থাকতে পারবো। শাশুড়ী বলে দিয়েছেন যতদিন আমার পরীক্ষা শেষ না হবে ইয়াসির যেন আমার বাবার বাড়িতেই থাকে। আমার খুশি কে দেখে! এত এত খুশি হয়েছি ইয়াহু বলে এক চিৎকার দিয়ে উঠলাম। আওয়াজটা এত বড় হয়ে গিয়েছিলো ইয়াসির আমার মুখটাই চেপে ধরলো। আমি ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে চুপ হয়ে গেলাম।
এই বাড়িতে যখন প্রথম বউ হয়ে আসি, দুইজন মানুষকে আমার একদমই সহ্য হতো না তারমধ্যে একজন আমার স্বামী, অন্যজন আমার শাশুড়ী। আর এই বাড়ির অন্য তিন বউকে আমার মানুষই মনে হতো না। সত্যি বলতে কি, তাদের দেখে আমার মায়া হতো। আমি এই বাড়ির সর্বশেষ বউ। আমার বড় তিন জা, এদের সবার স্বামীই প্রবাসী। এখনো এই ভাইদের দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। শুধু আমার সাহেবই দেশে বিজনেস করেন। সবার ছোট ছেলে হওয়াতে আমার শাশুড়ী উনাকে নিজের থেকে দূরে রাখতে চাননি। আমার স্বামীর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন আমার শ্বশুর দুনিয়ায় মায়া ত্যাগ করে আল্লাহর ডাকে সাড়া দেন। তখন থেকেই আমার শাশুড়ী একলা হাতে এই ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের বড় করে তোলেন। সব বাচ্চারাই ১৫ বছরের কম বয়সী ছিল। শত কষ্টের পরও এই অপূর্ব সুন্দরী বিধবা মহিলাটি সন্তানদের ইন্টার পর্যন্ত পড়ালেখা করিয়েছেন। এমনকি দুই মেয়ে সন্তাদেরও পিছিয়ে রাখেননি।
উনার ব্যপারে জেনে প্রথমেই উনার প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে এসেছিল। যখন এই বাড়িতে আসি সেই শ্রদ্ধা ঘৃণায় রুপ নিতে সময় নেয়নি। মনে হতো কোন মা এত কঠোর কীভাবে হতে পারে?!
একমাত্র আমার সাহেবই উচ্চ শিক্ষিত। এবং দেশে বিজনেস করেন। ভাইদের টাকায় বিজনেস করে দেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। এখন উনি বিজনেসের ব্যপারে আবেগহীন পাক্কা একজন ব্যবসায়ী।
তবে এদের মধ্যে একটা জিনিস বেশ ভাল লাগে, এরা ভাইয়ে ভাইয়ে প্রচন্ড মিল। একে অপরকে নিস্বার্থভাবে ভালবাসে। একে অপরের মতামতকে খুবই মূল্যায়ন করে। সবচেয়ে বেশি মূল্যায়ন করে আমার শাশুড়ীর মতামতকে। বলা যায় উনার কথার উপর একচুল পরিমাণও নিজের মত প্রকাশ করেন না। উনি সাপকে ব্যাঙ বললে ওরাও বিনাবাক্য ব্যয়ে মেনে নিবে! আর এই জিনিসটাই আমার একদমই অসহ্যের।
উনাদের বাড়িটা উপজেলা ভিত্তিক যে শহরগুলো হয় না? প্রায়ই শহরের ছোঁয়া লেগেছে কিন্তু আশেপাশের গ্রামীণ পরিবেশ শহরটাকে অনেক বেশি সুন্দর করে তোলেছে। এই বাড়িটা আমার কাছে আরেক অদ্ভুত মনে হয়! বিশাল বড় বাউন্ডারি! কী নেই এতে, মাঝারি সাইজের পুকুর, পুকুরের চারপাশে বেশ উঁচু বাউন্ডারি ওয়াল। পুকুরের পাড়ে নানা রকমের ফলের গাছ, সেখানে আপেল, আঙুর, কমলা, ডালিম, সফেদা থেকে শুরু করে নানা দেশি-বিদেশি ফলে সবসময় পূর্ণ। আর এই পুকুরের বাউন্ডারিতে শুধমাত্র বাগান পরিচর্যাকারী ছাড়া বাইরের সব পুরুষ সদস্যের প্রবেশ নিষিদ্ধ। এই এক আজব বিষয়!
তবে সব বউরা যখন খুশি পুকুরে যেতে পারবে। উঠানের এককোণেয় লোহার বড় এক দোলনা, যেখানে অনায়াসে দুইজন মানুষ আরাম করে শুইতে পারবে। কয়েকটা সাইকেল, প্রথম দেখেই আমার মনে হয়েছিল এখানে বড় সাইকেল চালানোর মত কেউ নেই তবে এত সাইকেল কেন?
আমার খুব বিরক্ত লাগে, শহরে নিজেদের বিশাল বড় বাড়ি থাকার পরও এরা কেন গ্রামে পরে থাকে। তবে শহরের সব সুযোগ সুবিধাও ভোগ করে। নিজেদের গাড়ি ছাড়া কোথাও যায় না। দুই বাড়িই খুব আধুনিকভাবেই তৈরি করেছে। শুনেছি বড় ভাইরা বিদেশের সিস্টেমেই সব কিছু করেছেন।
আর আমি অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়া অবস্থায়ই বাবা আমার পড়ালেখার, আমার মতামতের কোন তোয়াক্কা না করে এই বাড়িতে আমার বিয়ে ঠিক করেন। আমার সাহেবের সাথে বাবার অনেক আগে থেকেই ভাল সম্পর্ক। ব্যবসার দিক দিয়েই এদের পরিচয়।
এই বাড়িতে আসার পর থেকেই শুধু বাবার উপর প্রচণ্ড রাগ হতো। কেন বাবা এমন করলেন? এমনিতেই বাবা খুব শান্ত মানুষ। মায়ের কথার বাইরে কথা বলেন না। কিন্তু আমার বিয়ের ব্যপারে বাবা এত দৃঢ় কীভাবে হলেন বুঝে আসে না। মায়ের কোন কথা শুনেননি। এমনকি মাকে কয়েকবার এমনভাবে বকা দিয়েছেন আমার গরম মেজাজের মা চুপ করে থাকতে বাধ্য হয়েছে। হয়তো এই নতুন রুপটি মাকে বেশ অবাক করেছিল। যেমন আমরা সবাইও অবাক হয়েছিলাম।
এই বাড়ির তিন বউয়ের পাঁচটা সন্তান। দুই বছরের ছোট বাচ্চাটিসহ বাড়ির সবাই ফজরের আজানের সাথেসাথেই ঘুম থেকে জেগে যায়। পাঁচ বছরের ছোট বাচ্চাটিরও নামাজ পড়তেই হবে কোরান শেখা শুরু করেনি কিন্তু মায়ের সাথে মুখে মুখে দোয়া পড়তেই হবে। এশার নামাজ পড়ে রাতের খাবারের পরপরই সবার কেমনে ঘুম আসে আমি বুঝতে পারি না। আমার খুব রাগ হয়, আমার সারারাত ঘুম আসে না, আমার ঘুম আসার টাইমেই এরা জেগে যায়। আমার সারাদিন খুবই বিরক্তিতে দিন কাটতো। দুপুরে একটু ঘুমুতে পারতাম তাও দেড়/দুই ঘণ্টা আসরের আজানের সাথেসাথে সবাই উঠে যাবে। উফ্! এত কষ্ট অসহ্য। আমার জা'দের দেখলে মনে হয় এরা আমার শাশুড়ীর ভয়ে এমন; না কি এরা স্বাভাবগতপভাবেই এমন৷ বাড়ির যে কোন কাজ এরা কার আগে কে করবে ভেবে পায় না। বুয়াও আছে, আবার পার্মানেন্ট কাজের মেয়েও আছে। তাও শাশুড়ী গোসল করার পর এরা কার আগে কে শাশুড়ীর কাপড় ধুয়ে দিবে প্রতিযোগিতা করে।
আমার মাঝেমাঝে মনে হয় আল্লাহ এদের হিংসা, ঈর্ষা ছাড়াই বোধহয় দুনিয়েতে পাঠিয়েছেন।
আর আমার স্বামী, সে রুমের ভেতর খুব খুব ভাল একজন স্বামী। খুব হেল্পফুল, কেয়ারিং, লাভিং, আমাকে ছোট বাচ্চাদের মত স্নেহ করেন, ভালোবাসেন, বুকের গভীরে আগলে রাখতে চান।সবসময় একটা কথা বলেন, প্লীজ সুমাইয়া, মায়ের অবাধ্য হয়ও না। মা আমাদের বহু কষ্টে বড় করেছেন। কিন্তু রুমের বাইরে আসলেই সে অন্য মানুষ। আমার রাগ হতো কেন সে আমার সাপোর্টে কিছু বলতে পারে না? আমি বাবার বাড়ি যেতে চাই! কিন্তু না, নির্দিষ্ট সময় না হলে যেতে পারব না। একবারে একটা বউ বাবার বাড়ি যেতে পারবে। দশ দিন থেকে আসার পর অন্য বউ যেতে পারবে সিরিয়াল করে। কী অদ্ভুদ!
কারো যেতে ইচ্ছে হলেও যেতে পারবে না।
বিয়ের এক মাসের মাথায় সেদিন তো আমার আশ্চর্যের চরম সীমা পার হয়ে গেছে! রাতে নামাজের পর বাচ্চারা যখন ঘুমিয়ে গেল শাশুড়ী বললেন,
--অহ বউ, তোমরা সবাই একটু সাজুগুজু করতো, সবাই শাড়ি পর।
দেখলাম, সব বউ খুশি মনেই সাজুগুজু করতে চলে গেল। আমার আশ্চর্যের ঠেলা সামলাতে সময় লাগছিল বলে দেরী হচ্ছিলো শাশুড়ী আবার বললেন, মা'রে আমার ইয়াসির বাসায় আছে তাই সাজতে বেলছিলাম, যদি তোমার সাজতে ইচ্ছে না করে না সাজ সমস্যা নেই।
আমি এমনিতেই সাজুগুজু করতে ভালোবাসি। কিন্তু এই মহিলার কথার বিরুধীতা করার জন্যই আমি না সেজে সোজা রুমে চলে গেলাম।
একটা জিনিস মাথায় ঢুকছে না, আমার না হয় ইয়াসির বাসায় আছে বলেই সাজতে বললেন কিন্তু সব ভাবীদের কেন সাজতে হবে!? যার উত্তর জানলাম পরেরদিন ওরা সবাই রাতে জামাইদের সাথে ভিডিও কলে কথা বলে। এর পরে প্রায়ই দেখতাম ওরা রাতে সাজতেছে।
সেদিন আমার বড় জায়ের ছেলেটা প্রি-পোজিশনের ব্যবহারে কিছু ভুল এক্সাম্পল পড়ছিলো, আমি পাশেই ছিলাম আমি তার ভুলটা ধরিয়ে দিয়ে কী এক মহা বিপদ ডেকে এনেছি!
শাশুড়ী বললেন,
- সেমাইয়া আজ থেকে তুমিই টাইম করে এদের তিনজনকে পড়াবে৷
উফ! কী যে অসহ্য লাগছিলো কথাগুলো! উনার সামনে তো কিছুই বলতে পারিনি কিন্তু রুমে গিয়ে ইয়াসিরের সাথে অনেক ঝগড়া করি। ওকে এত এত কথা শুনিয়েছি, সে পালটা একটা কথাও বলেনি। আমার এত এত তীর্যক কথার বিনিময়ে আমার আরো ভালোভাসাই ভরিয়া দিয়ে একটা কথাই বলেছিল,
-- সুমাইয়া মায়ের কথা শুনে দেখ না, হয়তো তোমার ভালই লাগবে।
: আমার ভালো লাগবে না। তোমার সব ভাবিদের উপর যেমন চাপিয়ে দিয়েছে সবকিছু তেমনি আমাকেও তাই করতে বলছে।
--তুমি ভুল বুঝছ, মায়ের দেওয়া দায়িত্ব পালনে ভাবিদের কখনো বিরক্ত হতে দেখেছ? তারা বরং খুব হাসি মুখেই সব দায়িত্ব পালন করে।
তা ঠিক তারা কখনো বিরক্ত হন না। এমন নয় যে খুশি হওয়ার ভান ধরে। সত্যিকারভাবে খুশি হয়েই ওরা শাশুড়ীর প্রতি দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু ইয়াসির কীভাবে জানলো? সে তো কখনো ভাবীদের চেহারাও দেখেনি!
এই বাড়ির আরেকটা খুবই আজব নিয়ম, একটা মাত্র পুরুষ মানুষ কিন্তু তার সামনে কেউ যায় না শুধু শাশুড়ী ছাড়া। টেবিলে খাবার দিয়ে সবাই আড়ালে চলে যায়। অবশ্য এই নিয়মটা আমার ভালই লাগে। যদি ইয়াসির ওর সুন্দরী ভাবীদের
সাথে ঠাট্টা -মসকরা করতো আমার ভাল লাগতো না।
যাক, শুধুমাত্র ইয়াসিরের কথা রাখার জন্য বাচ্চাদের পড়ানো শুরু করলাম। তিনজনকে তিন টাইমে পড়াই। আগের টিচারকে বিধায় করা হয়েছে। প্রথম দিকে ওদের পড়াতে ভালো না লাগলেও আস্তে আস্তে বেশ ভাল লাগতো। বাচ্চা৷ তিনটাই অতি ব্রিলিয়ান্ট। বাচ্চাদের তিন টাইম পড়াইয়ে আমি খুব ক্লান্ত হয়ে যেতাম ঘরের কাজ করতে কিছুতেই মন চাইত না। তাও শাশুড়ী ভয়ে কাজ করতে গেলাম। এমনিতেই বড় জা, আমার কাছ থেকে ঝাড়ু কেড়ে নিয়ে বললো,
-- তোমার কোন কাজ করতে হবে না, এটা মায়ের আদেশ।
সাথে মা রুম থেকে বলে উঠলো,
: হ্যা রে বউ, তোমার কাজের চিন্তা করতে হবে না। তুমি মানুষ না কি। কত কষ্ট কর আমার নাতিদের জন্য। আবার কাজও। না মা আমি অতটাও খারাপ নই।
মনে হলো প্রথমবারই এই মহিলাকে একটু ভাল মনে হলো। যাক কাজ থেকে তো মুক্তি পেলাম। তারউপর এমন ট্রিট পেতাম নিজেকে রাজকুমারী মনে হতো। যেহেতু কাজ করতে হয় না নিজের পড়ালেখার পাশাপাশি এদের পড়াতেও আরো একটু মনোযোগী হলাম। পড়ার কিছুদিন পর, সম্ভবত এক মাস পর আমি এত বেশি অবাক হয়েছি আমি কয়েকটা হার্টবিট বোধহয় মিস করে গেলাম। আমার শাশুড়ী আমার হাতে আট হাজার টাকাসহ এক খাম তুলে দিয়ে বললেন,
: আগের মাস্টারকে সাত হাজার দিতাম তোমাকে একহাজার বাড়িয়ে দিলাম কারণ তুমি আমার নাতিদের অনেক আদর করে পড়াও। তাছাড়া খুব কষ্ট করে নিজের পড়ার পাশাপাশি এদের পড়াও।
আমি কখনো ভাবিনি এদের পড়াইয়ে টাকা নিব। আমি বাচ্চাদের ভালোবাসি। ওরা যখন ছোট আম্মু করে করে পাগল করে তুলে আমার বেশ ভাল লাগে। শাশুড়ীকে বললাম
: না মা, আমার টাকা লাগবে না, আপনার ছেলে আমাকে কোন কিছুর কমতি রাখেনি, না চাইতেই আমার হাতখরচ দিয়ে দেয়।
--রাখ বউ মা, এটা তোমার কষ্টের ফসল আর তোমার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা।
না নিলে আমি কষ্ট পাব।
না চাইতেও নিলাম। কিন্তু এক অন্যরকম তৃপ্তি পেলাম। জীবনে প্রথম নিজের উপার্জনের টাকা।
মনে আসলো, উনি বোধহয় সব বউদেরই কোন না কোন ভাবে এভাবে পুরুস্কৃত করেন। হয়তো তাই উনার বউরা কোন কিছুতে বিরক্ত হয় না।
এর কিছুদিন পরেই আমার পরীক্ষা, আমি ইয়াসিরকে নিয়ে বাবার বাড়িতে চলে গেলাম। এত এত আনন্দ লাগছিলো। অনেকদিন পরেই বাবার বাড়িতে একটু আনন্দ করে বেশিদিন থাকতে পারবো। শাশুড়ী বলে দিয়েছেন যতদিন আমার পরীক্ষা শেষ না হবে ইয়াসির যেন আমার বাবার বাড়িতেই থাকে। আমার খুশি কে দেখে! এত এত খুশি হয়েছি ইয়াহু বলে এক চিৎকার দিয়ে উঠলাম। আওয়াজটা এত বড় হয়ে গিয়েছিলো ইয়াসির আমার মুখটাই চেপে ধরলো। আমি ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে চুপ হয়ে গেলাম।