সবুজ খামে না বলা কথা | Sobuj Khame Na Bola Kotha (Full & Final)
সে-বার পরীক্ষা শেষে দাদুর সাথে উনার বোনের মেয়ের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম। বৃষ্টিতে বাড়িতে ঢুকতে যাবো এমন সময় ধপাস করে পড়ে গেলাম উঠোনে। ফুফুটা( দাদুর বোনের মেয়ে) এগিয়ে এসে খুব দুঃখ করে ভেতরে নিয়ে গেলেন আমায়, কিন্তু দূর থেকে কারো যেন জোরে হাসির শব্দ শোনা গেলো। আমি চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম কাউকে দেখতে ফেলাম না। তখন ফুফু বললেন, "
এই হিমু একদম হাসবি না, দেখছিস মেয়েটা পড়ে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছে, তুই আবার হাসছিস?"
তখন খেয়াল করলাম আমার ঠিক মাথার উপর পেয়েরা গাছের ডালে বসে হিমু ভাই হাসছে। উনার হাসি দেখে লজ্জায় মাথা কাটা গেছে আমার। ইচ্ছে করছিল ছুটতে চলে যাই। কিন্তু সবার সামনে তা করা গেল না। আমি এই বাড়িতে প্রায় পনেরো বছর পর এসেছি। যখন ৬বছর বয়স ছিল তখন নাকি একবার এসেছিলাম। আমার অবশ্য মনে নেই, দাদুর কাছে শুনেছি।
সে-বার এসে নাকি হিমালয় ভাইয়ার পিছু পিছু সারাক্ষণ থাকতাম। তাই উনি নাকি দুষ্টুমি করে বলতেন তুই আমার বউ। সেজন্য পেছনে পেছনে ঘুরিস! আমি নাকি সেদিন থেকে ভাইয়াকে বলতাম আমি তোমার বউ। যখন দাদু ফুফু এসব বলছিলেন এতো লজ্জায় ইচ্ছে করেছিল,ইচ্ছে করছিল মাটির ভেতর ফাঁক করে ঢুকে যাই।
না তা আর করা গেল না। বুকের ভেতরটায় শব্দের গতি যেন বেড়ে গেল হাজার গুণে। ফ্রেশ হয়ে খেয়ে মাথা ধরেছে বলে শুয়ে পড়লাম আমার জন্য নির্দিষ্ট করা রুমে।
সারাদিনে একবারও বের হলাম না। রাতে খেতে ডেকেছে তখনও বের হতে চাইলাম না। মাথা ব্যাথার অজুহাতে শুয়ে রইলাম ঘর অন্ধকার করে। দাদু অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও আমাকে উঠাতে পারলেন না, অগত্যা উনাকে চলে যেতে হলো। রাতে আমার কাছে ঘুমাতে চাইলেন কিন্তু আমি বললাম,
"তুমি অনেক দিন পর এসেছো, আজ ফুফুর সাথে ঘুমাও, গল্প করো দাদু,আমার সাথে তো সবসময়ই ঘুমাও।"
আমার কথাটা মনে ধরলো দাদুর, উনি চলে গেলেন। সে রাতে আমার ঘুম হলো না। কোনো এক অজানা কারণে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম আমি। এই যে এতো গুলো বছর দেখিনি বলে কী আজ এতো কষ্ট হচ্ছে আমার? জানি না কেন বুঝ হওয়ার পর থেকে হিমালয় নামটার বাইরে আমি যেতে পারিনি। স্কুল কলেজে সুন্দরী বলে সবসময়ই আমার একটা প্রসংশা ছিল, অনেক প্রেমের প্রস্তাবও পেয়েছি। কিন্তু কখনো মন টানেনি, মনে হতো আমার মন তো অন্য কারো কাছে বাঁধা পড়ে আছে।
যার ছবি আমি বড় হয়ে দেখিনি পর্যন্ত। ভাবছেন তথ্য প্রযুক্তির যুগে একটা ছবি জোগাড় করা কী এমন কঠিন কাজ! ঠিকই বলেছেন।
আসলে আমি দেখতে চাইনি। সেই ছয় বছর বয়সের পর থেকে ইচ্ছে করে দেখিনি তাকে। চার পাঁঁচবার এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে আমিই দেখা দেইনি। অবশ্য উনিও যে আমাকে খুঁজেছেন তা নয়। এসেছেন দাদুর সাথে দেখা করতে আবার চলেও গেছেন।আমিও তাই সামনে যাইনি কিংবা যেতে চাইনি। তার কারণ না হয় একটু পর জানলেন!
সকালে যখন আমার ঘুম ভাঙে দেখলাম সবাই আমার বিছানার পাশে বসে আছে, সকলের কপালে চিন্তার ভাব স্পষ্ট । অবাক হলাম আমি! "কী ব্যাপার সবাই এভাবে বসে আছে কেন? "
আমি উঠে বসতে যাব এমন সময় বুঝলাম উঠতে পারছি না, পুরো শরীর ব্যাথা হয়ে আছে। তখন ফুফু বললেন,
"উঠিস নারে মা, সারারাত যেভাবে জ্বরে পুড়ে যাচ্ছিলি, আমি তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। কীভাবে মরার মতো পড়ে ছিলি তুই, রাত পার হয়ে দিনের তিনটে বাজে তাও তোর ঘুম ভাঙছে না দেখে খালাম্মা কাঁদতে কাঁদতে শেষ। ভাগ্যিস হিমু ছিল বলে বাঁচা গেছে, নয়তো কি যে হতো আল্লাহই জানে। এত রাতে তো আর ডাক্তার পাওয়া যেত না৷ ওহ আপনাদের তো একটা কথা বলাই হয়নি, হিমু ভাই তখন ডাক্তারি পড়া শেষ করেছেন।
দাদু তো কেঁদে কেটে গাল ফুলিয়ে ফেলেছে। কান্না গলায় বললেন, " তোর এখন কেমন লাগছে রে জোনাকি?" বেশি খারাপ লাগলে বল আমি তোকে ডাক্তার খানায় নিয়া যাব। কয়দিনের জন্য গ্রামে আসলি তাও যদি এমন হয় তোর বাবা তো চিন্তা করে মারা যাবে। হিমু দাদুভাই ছিল বলে রক্ষে, সেই তো সারারাত তোর মাথার কাছে বসে ছিল। আমাকে আর রেহেনাকে বসতেই দিল না। তোর মাথায় পানি দিয়েছে, একটু পর পর তুই পানি চাইতি পানি খাইয়ে দিয়েছে। আল্লাহ তোমারে বাঁচাই রাখুক ভাই।" লাস্টের কথাটা দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হিমু ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন দাদু।
সবটা শুনে আমার হার্টবিট আরও কয়েক হাজার গুণ দ্রুত গতিতে বেড়ে গেল। হিমু ভাই আমার টেক কেয়ার করেছে! এটাও সম্ভব! বিস্ফারিত চোখে আমি একবার তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম। সাহেব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফোন গুতাচ্ছেন, একটা বার ফিরেও তাকাচ্ছেন না। খুব রাগ হলো আমার তাই আবার চোখ বুজে গেলাম। দাদু আবার ভেজা গলায় বললেন, "কিরে জোনাকি আবার কষ্ট হচ্ছে তোর? চোখ বুজলি কেন?"
বিষন্ন মন নিয়ে চুপ করে রইলাম আমি কথা বলতে ইচ্ছেই করল না। অনেক বছরের অভিমান জমে আছে। টের পেলাম কেউ আমার হাত ধরেছে মনে হলো এটাতো দাদুর হাত না, এই উষ্ণ হাতের স্পর্শটা মনে হলো অনেক পরিচিত। চোখ খুলে দেখলাম ডাক্তার সাহেব আমার প্রেশার মাপার জন্য মেশিন "স্ফিগমোমানোমিটার" হাতে লাগাচ্ছে। হলুদাভ মুখে খোচাখোচা দাড়ি তীক্ষ্ণ নাকটায় বিন্দু বিন্দু শিশিরের মতো ঘাম জমেছে দেখতে যে কী ভীষণ সুখ সুখ মনে হলো! আমার কল্পনায় আঁকা সেই মানুষটির মতোই হুবহু মিলে গেল। যার ছবি এই পনেরো বছরে একটু একটু করে এঁকেছি আমার মনের আকাশে।
এক ফলক দেখে আবার চোখ বন্ধ করে ফেললাম। সে-তো আমার দিকে তাকাচ্ছে না, তবে আমি কেন তাকাব?
কেমন গম্ভীর গলায় ফুফুকে বললেন খাবার নিয়ে আসতে। ফুফু খাবার নিয়ে এসে আমাকে ওঠাতে চেষ্টা করলেন, আমি খাব না বলায় একটা চিৎকারে সব ব্যাথা ভুলে আমি দপ করে বসে পড়লাম। তাকিয়ে দেখলাম হিমু ভাই আমাকে বলছেন, "এই মেয়ে তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও, তুমি কী মনে করেছো সারাদিন আমার কোন কাজ নেই? বসে বসে তোমার সেবা করব? তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও"।
এতো জোরে ধমক আমার বাবা-মাও কখনো দেয়নি। অভিমানের সাথে কষ্ট যোগ হলো। তার ফলস্বরূপ চোখে নোনা জল ঝরতে লাগল। ফুফু খাইয়ে দিবেন বলে যেই আমার কাছে আসছিলেন, হিমু ভাই বলল, " আমার কাছে দাও মা, দেখো কীভাবে খাওয়াতে হয়,তোমারা আসলে আদর করে করে বাচ্চাদের বাঁদর বানিয়ে ফেলো। উত্তম-মধ্যম কয়েকটি পড়লে তবেই এরা ঠিক হবে। অবাক হলাম আমি একুশ বছরের একটা মেয়েকে কি-না বাচ্চা বলছে?
সেই প্রথম এক প্লেট ভাত খেলাম আমি। আমার মাও জীবনে এতোটা শাসন আমায় করেনি। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে দাদু ও ফুফু দুজন সেখান থেকে চলে গেলেন। কেউ কিছুই বললেন না! মনে মনে ভাবলাম কেন যে এখানে এসেছি! একে-তো পড়ে অসুখ বাধিয়েছি তার উপর এমন ধমকাচ্ছে, ইচ্ছে করছে বেটার ঘাড় মটকে দেই। এমন সময় ডাক্তার সাহেব বলল, "মনে মনে আমাকে গালি দিচ্ছো দাও, তবে এখানে যতদিন আছো ঠিকমতো খেয়ে নিবে। যদি তা না করো বুঝবো তোমার আমার হাতে খেতে ইচ্ছে করছে বুঝলে?
আমি ভাত ভর্তি মুখ নিয়ে উপর-নিচ মাথা নাড়ালাম।
সাহেব হাত ধুয়ে ওষুধ খাইয়ে দিয়ে চলে গেল। জানি না কেন আমার জ্বরটা একদম চলে গেল। একটু আগে যে রাগ-অভিমান, কষ্ট হয়েছিল তা এক নিমিষেই উধাও হয়ে গেল। সন্ধ্যার দিকে অনেকটাই সুস্থ অনুভব করলাম আমি। সবাই উঠানে বসে নানা গল্প করছিলো। ওসব সাংসারিক গল্প আমার ভালো লাগছিল না, তাই আমি ছাদে চলে গেলাম, এসেছি পর্যন্ত ঘর থেকে আর বেরুতে পারিনি। এখন শীতল বাতাসে অনেকটা ভালোই লাগছে।
জোরে বাতাস বইছে দেখে মন আনন্দে নেচে উঠল,বরাবরই আমি প্রকৃতি প্রেমী, প্রকৃতি আমাকে পাগল করে দেয়। তাই দুহাত উঁচু করে কিছুটা সময় ঘুরতে লাগলাম, মনটা কেমন শান্ত হয়ে যাচ্ছিলো, নিজেকে মুক্ত পাখি মনে হচ্ছিল, কিন্তু বিপত্তি ঘটলো যখন ব্যালেন্স ঠিক রাখতে না পেরে পড়ে যাচ্ছিলাম, কিন্তু খানিক বাদে বুঝলাম আমি পড়িনি কারো বুকের সাথে লেপ্টে আছি। সেই আগুন্তকের শরীর থেকে খুব সুন্দর পারফিউমের গন্ধ নাকে এসে লাগছে, চেনা পারফিউমের গন্ধ মনে হচ্ছে , দুপুরে যখন হিমু ভাই খাইয়ে দিচ্ছিলেন তখন লেগেছিল।
কেমন যেন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো আমার। বুকের ভেতর ধুকপুকানি বেড়ে গেলো হাজার গুণে। মনে হলো এবার বোধহয় আমি অজ্ঞান হয়ে যাব। কীভাবে শক্ত করে ধরেছেন লোকটা আমাকে। এখন আমি যদি মরে যাই তিনিই তার জন্য দায়ী থাকবেন।
কিন্তু অদ্ভুতভাবে আমি কেমন একটা সুক্ষ্ম সুখ অনুভব করতে লাগলাম। জানি না সে সুখের নাম কী! শুধু মনে হচ্ছিলো সময়টা এখানেই থেমে যাক। আমি এভাবেই থাকি অনন্ত কাল। কিন্তু না, আমার ভাবনায় কেরোসিন ঢেলে দিয়ে হিমু ভাই ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন আমায়। পুরাই বোকা হয়ে গেলাম আমি। আমি তো তাকে ধরতে বলিনি! ধরছেই যখন এভাবে ছুড়ে ফেলে দেয়ার কী মানে! রাগে, দুঃখে আমার কান্না পেয়ে গেল। কিন্তু তার সামনে যতটা সম্ভব কান্না চেপে রাখলাম। তিনি আমাকে বললেন, "ঠিক করে হাঁটতেও শিখনি? ধুমধাম পড়ে যাচ্ছো?"
নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না আমি বললাম, "আমি হাঁটতে না পারলেই বা আপনার কী? আপনাকে কেউ বলেনি আমাকে ধরতে।"
আমার কথা শুনে আগুন চোখে তাকালো সে আমার দিকে। চাঁদের আলোতে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। ঝলঝল করছে তার আগুন লাগা চোখ দুটি! উঁহু মায়াবী চোখ দুটি!
আমাকে অবাক করে দিয়ে সেদিন তিনি আমার হাত দুটি পেছন থেকে মচকে ধরলেন। ব্যাথায় কুকড়ে গেলাম আমি। কিন্তু কোনো শব্দ করলাম না। এতক্ষণ আগে যে চেষ্টাটা করেছিলাম চোখের জল আটকে রাখতে, সেটা আর করা গেলো না। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। তিনি বুঝেছেন কি-না জানি না। তার এমন কান্ডে আমি খুব অবাক হলাম। এমনটা উনি কেন করলেন? কিছুই বললেন না তিনি। চুপচাপ নেমে গেলেন ছাদ থেকে। অপমানে, কষ্টে কেঁদেছি বসে আমি।
যে মানুষটাকে এতো বছর ধরে ভালবেসে আসছি। সে আমার সাথে এরূপ আচরণ কেন করছে? ভেবেছিলাম এখানে এসে তাকে আমার মনের কথা জানাব কিন্তু না, সে আর পারলাম কই! আমার সাথে কথা পর্যন্ত বলে না সে। তাই মনে মনে ঠিক করলাম তাকে আর কিছুই বলব না। যে আমার প্রতি এতটা উদাসীন তার কাছে ভালবাসার কথা প্রকাশ করে দুঃখ বাড়ানো ছাড়া আর কিছুই হবে না। সেদিনও গিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়লাম। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে দেখি হিমু ভাই আমার পাশে বসে আছেন। সময় দেখার জন্য ফোন খুঁজছিলাম। দেখলাম তখন রাত দুটো। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে! কি ব্যাপার কেন এসেছেন তিনি আমার কাছে!
#সবুজ_খামে_না_বলা_কথা
#প্রজ্ঞা_জামান_দৃঢ়তা (১ম পর্ব)
২য় ও শেষ পর্ব Full & Final
রাতের বেলা হিমু ভাইকে দেখে আমি খুব অবাক হলাম, চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বসে ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম তিনি আমার দিকে কেমন মায়াবী চোখে তাকিয়ে আছেন। বিস্ময়ে আমার মুখ থেকে একটা কথাও বের হলো না। কিছুটা সময় কেটে গেল অস্বস্তিতে তিনি বললেন,
"কয়েক ঘন্টা পর আমার ফ্লাইট,উচ্চশিক্ষায় জন্য আমেরিকা যাচ্ছি। তবে শুধু চার বছরের জন্য। পড়া শেষ হতেই চলে আসব। ভালো করে পড়াশোনা করবে। কোনোকিছু নিয়ে চিন্তা করবে না। তুমি এখনো ছোট তাই সবকিছু নিয়ে বেশি চিন্তা করা উচিত নয়। আগে বড় হও তারপর সবকিছু নিয়ে চিন্তা করবে। খাওয়া ঘুম ঠিক রাখবে। আর হ্যাঁ দেখেশুনে হাঁটবে, ঠিকমতো হাঁটতেও শিখনি!"
উনার কথাগুলো শুনে আমি অবাকের উপর অবাক হলাম! হুট করে এসে বলছে আমেরিকা চলে যাচ্ছে, যাচ্ছে যাক না, আমাকে বলার কী আছে? আবার তিরস্কার করে বলছে আমি নাকি ছোট! আমি হাঁটতে পারি না! যাবে যাক আমাকে এত কথা শুনাতে আসা কেন শুনি! রাগে দুঃখে অভিমানে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল আমার। কিন্তু না এই পাথরটার সামনে কাঁদা যাবে না। এই মানুষটি কোনোদিন আমাকে বুঝেনি। তার জন্য কেন কাঁদব আমি। বয়েই গেছে আমার! একদম কাঁদব না বাজে লোকটার জন্য। কিন্তু না আমার অবাধ্য মন কথা শুনল না। সে কেঁদেই ফেলল।
হিমু ভাই তা দেখে বললেন,
"সাধে কী বাচ্চা বলি? দেখো কেমন কান্না জুড়ে দিছে! এই মেয়ে একদম কান্নাকাটি করবে না। আমি কান্না একদম পছন্দ করি না। ইচ্ছে হলে আমি চলে গেলে বালিশ জড়িয়ে অশ্রুপাত করো।"
তার এই কথায় আমার কষ্ট আরো বেড়ে গেল। কী কঠিন মানুষ কেউ কান্না করলে তাকে সান্ত্বনা দিতে হয়, তা না করে ধমকাচ্ছেন এটা কেমন বিচার? রাগে অভিমানে একটা কথাও বললাম না আমি, একবার তার দিকে তাকিয়েও দেখলাম না। তবে এটা বুঝতে পারলাম সে মানুষটি আমাকে দেখছে খুব কাছ থেকে।
সেও কিছু বলল না। বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। আমার বুক ফেটে কান্না আসলো। ঘরের আলো বন্ধ করে দিয়ে সত্যি বালিশ বুকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলাম।
মিনিট দশেক পর তিনি আবার আসলেন আমার কাছে। হাতে একটা সবুজ খাম নিয়ে। আমাকে দিয়ে বললেন এটা তোমার জন্য।
আমি নিতে চাইলাম না। কিন্তু জোর করে আমার হাত মেলে খামটা ধরিয়ে দিলেন। বললেন, "কিছু টাকা আছে, বাচ্চা মানুষ তুমি তাই চকলেট খেও, সবাইকে দিয়েছি ভাবলাম তোমাকেও দেই।"
খামসহ আমার হাতটা কেমন আলতো করে ধরে রাখলেন কিছু সময়। আমি নিচের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে থাকলাম। হঠাৎ তিনি আমার মাথায় হাত রাখলেন, আমার যেন কী হলো হুট করে উঠে আমি তাকে জড়িয়ে ধরলাম। তিনি কেমন শক্ত হয়ে রইলেন। অনেকটা সময় আমি তার বুকে সত্যি বাচ্চাদের মতো মুখ গুঁজে কাঁদলাম। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে উনি একবারও তার হাত দুটো আমাকে জড়িয়ে ধরল না। এমনকি আমাকে সরিয়েও দিলেন না।
হঠাৎ আমার সম্বিৎ ফেরে আমি সরে আসি তাকে ছেড়ে। তার চোখের দিকে তাকাতে পারিনি আমি লজ্জায়। কিন্তু আমার খুব ইচ্ছে ছিল আমি জড়িয়ে ধরার পর তার চেহেরাটা কেমন হয় দেখতে। কিন্তু তা আর দেখা হলো না। বেড়িয়ে গেল সে। আমি জানালা খুলে দেখলাম তার চলে যাওয়া। সেও কাঁদছে তার মাকে জড়িয়ে। গাড়িতে উঠার সময় সে জানালার দিকে তাকাল। আমার চোখে চোখ পড়তেই গাড়িতে উঠে গেল। একটু একটু করে গাড়িটা চোখের আড়াল হলো। আর আমার বুকের ভেতরটাও একটু একটু করে খালি হয়ে গেল।
অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাতে লাগলাম আমি। পাগলের মতো কেঁদেছি।
★★★
পরদিন নিজের বাসায় চলে আসি। দাদু চাইলেও থাকলাম না আমি। ওই বাড়িতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল মানুষটাকে ছাড়া। প্রতিটি মুহূর্তে তাকে মনে হয়েছে আমার। খামটা আর রাগ করে খুলে দেখিনি। কী ভেবেছে সে আমি তার টাকায় চকলেট কিনে খাব! কক্ষনো না। সেটি হচ্ছে না। খামটা আমার আলমারিতে একটা বাক্সে রেখে দিলাম। কোনোদিন সে খাম খুলব না বলে ঠিক করলাম। কোথায় ভেবেছি চিঠি হবে, না তা না, সাহেব আমাকে টাকা দিয়েছে!
একবুক অভিযোগ, অভিমান নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে লাগলাম। খুব করে চাইতাম তার জন্য অপেক্ষা না করতে, কিন্তু না মন কী আমাদের কথা শুনে! বেইমান মন নিজের হয়ে অন্যের কথা ভাবতেই ভালোবাসে। অন্যের জন্য কষ্ট পেতে পছন্দ করে। প্রতিদিন আমার অবচেতন মন তার ফোনের অপেক্ষায় দিন কাটাতে লাগল। কিন্তু না কোনো কল আসত না। রাতের বেলা সবার অগোচরে কাঁদতাম। এভাবে চলে গেল চার বছর।
মাঝে মাঝে কল দিয়ে দাদু ও আম্মুর সাথে কথা বলতেন হিমু ভাই। কিন্তু কোনোদিন আমার সাথে বলত না। দিনদিন রাগ অভিমান বেড়ে গেল আমার। মাঝেমাঝে খুব ইচ্ছে করত একটা কল দেই। কিন্তু দিতাম না। কতবার যে এ-ই চারবছরে তার নম্বর ডায়েল করে আবার কেটে দিয়েছে তার কোনো হিসেব নেই। হঠাৎ করে দাদু মারা গেলেন। আমার একমাত্র বন্ধু ছিল দাদু, তার চলে যাওয়া আমাকে একেবারে ভেঙে দিল। কিচ্ছু ভালো লাগত না। দম বন্ধ হয়ে আসত আমার।
দিনদিন আমার মতো চঞ্চল মেয়েও কেমন চুপচাপ হয়ে গেল। কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করত না। কোথাও বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করত না
আমার এই অবস্থা দেখে বাবা-মা চিন্তায় পড়ে গেলেন।
তারা ঠিক করলেন আমার বিয়ে দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে ঠিক করে ফেললেন। আমি অনেকবার বলেছি বিয়ে করব না। কিন্তু বাবা-মা শুনেনি। তাদের কি করে বলি আমার পক্ষে অন্যকাউকে ভালোবাসা সম্ভব নয়। একজনকে ভালোবেসেই যে আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। বুঝ হওয়ার পর থেকে ও-ই একজনকেই যে স্বামী হিসেবে মেনে এসেছি। কি করে অন্যকাউকে স্বামী রূপে ভাবব আমি!
কি করব ভেবে না পেয়ে সব রাগ ভুলে তাকে কল দিলাম। কিন্তু ফোন বেজে গেলেও হিমু ভাই ধরলেন না। সেদিন আমার মৃত্যু যন্ত্রণা হয়েছিল। এত কেঁদেছি যে টানা এক সপ্তাহ জ্বরের জন্য চোখ মেলতে পারিনি। এর ফল স্বরূপ আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল আমার বাবার বন্ধুর ছেলে আতিফের সাথে। সেও নাকি ডাক্তার। আমেরিকা থাকে। আমাকেও বিয়ের দুই সপ্তাহের ভেতর নিয়ে যাবে তার সাথে।
বাবাকে অনেক বলেছি বিয়ে পিছিয়ে দিতে তিনি কারণ জানতে চাইলেন, কিন্তু আমার কাছে বলার মতো কোনো কারণ ছিল না। আমি কি করে বলি আমি এমন একজন মানুষকে ভালোবাসি যে - কিনা আমাকে ভালোবাসে কি-না জানিই না আমি। কোন মুখে বাবাকে বলব বাবা আমি হিমু ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করব! কারো অপেক্ষা করার জন্য হলেও তার অনুমতি প্রয়োজন। আমি যেখানে জানিই না সে আমার আছে কি-না সেখানে বাবাকে তার জন্য অপেক্ষা করছি বলাটা বিলাসিতা বৈ আর কিছুই মনে হলো না। তাই চেয়েও কিছুই করতে পারলাম না আমি।
★★★
বিয়ে হয়ে গেল আমার। বিয়ের দিন খুব কেঁদেছি। কবুল বলার এক মিনিট আগেও আমি আমার ফোনটা দেখেছি, শুধু এ-ই আশায় যদি একটা কল আসে, একটা!
না আসেনি কোনো কল আসেনি। কাগজে কলমে আমি হয়ে গেলাম অন্যকারো।
নতুন একটা মানুষের সাথে নতুন অজানা জীবন শুরু হলো আমার। আতিফ ভালো মানুষ। আমাকে যথেষ্ট ভালোবাসে বলেই মনে হয়। অনেক যত্নও করে। প্রতিদিন বাসায় আসার সময় গোলাপ নিয়ে আসে। আমাকে খুশি রাখার সব চেষ্টা সে করে। আমি চুপচাপ থাকি দেখে বাইরে নিয়ে যায়।
কিন্তু তাকে কি করে বুঝাই আমি যে অন্য কারো বিরহে জ্বলে যাচ্ছি, পুড়ে যাচ্ছি। তার এত যত্নও যে সে মানুষটিকে ভুলাতে সক্ষম হচ্ছে না। হবেই বা কি করে যে মানুষটাকে এতগুলো বছর ভালোবেসে এসেছি তাকে ভুলা কি এতটাই সহজ!
★★★
বিয়ের চৌদ্দ দিনের মাথায় আমেরিকা পাড়ি দিলাম আতিফের সাথে। সাথে নিয়ে গেলাম সবুজ খামটা। প্রায় খামটা বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে রাখি, কেন জানি একটা শান্তি অনুভব হয় আমার। হয়তো তার হাতের ছোঁয়া আছে তাই। আমেরিকা যাওয়ার দুইদিন পর আতিফ আমাকে তার এক ডাক্তার বন্ধুর সাথে দেখা করাতে নিয়ে গেল।
আমাদের বিয়ের পর প্রায় তার এ-ই বন্ধুটির কথা সে বলত। তার ডাক্তার বন্ধুর সুন্দর আর অদ্ভুত একটা ভালোবাসার গল্প আছে। শুনে মনে হয় মেয়েটা অনেক ভাগ্যবতী নয়তো এমন ভালোবাসা কারো পায়। আচ্ছা একটু পর না হয় বলি আপনাদের তার বন্ধুর ভালোবাসার কাহিনী।
ভদ্রলোক নাকি দেশে যাবেন কাল, দেশে গিয়েই বিয়ে করবেন তার ভালোবাসার মানুষকে। তাই আজ দেখা করতে যাব আমরা।
আতিফের বন্ধুর সাথে ডিনারে দেখা করতে গেলাম। আমরা কিছুক্ষণ বসার পর ভদ্রলোক এলেন। আমি বসে বসে ফোনে খালাতো বোনের সাথে টেক্সট করছিলাম। তাই প্রথমে খেয়াল করিনি। আতিফ যখন বলল, "জোনাকি মিট মাই ফ্রেন্ড হিমালয়।"
"হিমালয়" নামটা শুনে থমকে গেলাম আমি। তাকিয়ে দেখলাম শুধু নামটা নয় মানুষটাও আমার পরিচিত। খুব, খুব, খুব পরিচিত! হিমু ভাই অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। দেখতে আগের থেকে আরও সুন্দর হয়ে গেছেন। দুজন দুজনের দিকে কিছুটা সময় তাকিয়ে রইলাম। আতিফ বলে যে আরেকটি প্রাণী এখানে আছে সেটা বেমালুম ভুলে গেলাম আমরা।
আতিফের গলায় চেতনা ফিরে দুজনের। "তোমারা দুজন দুজনকে চেনো নাকি?"
আমি কিছুই বলতে পারলাম না। হিমু ভাই বললেন, "আরে জোনাকি যে কেমন আছো?"
"জি ভালো। " কোনো রকম উত্তর দিলাম আমি। সে কেমন আছে তাও জিজ্ঞেস করার শক্তি আমার ছিল না।
আতিফ আমার দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিল, গ্লাসটা নিতে গিয়ে তার গায়ে পড়ে গেল। পানি পড়ে তার প্যান্ট ভিজে গেল। তাই সে ওয়াশরুমে চলে গেল।
আমাকে এক আকাশ অস্বস্তি ঘিরে ধরল। নিচের দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি। হিমু ভাই যে আমাকে দেখছেন আমার শরীরের প্রতিটি শিরায় শিরায় সেটা জানান দিচ্ছিল। আমার ইচ্ছে করছিল সামনে থাকা মানুষটাকে জড়িয়ে ধরতে। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার বুকে মাথা রেখে। কিন্তু আজ সেটা ভাবাও যে অন্যায়। শুধু অন্যায় নয় অপরাধও বটে! আজ যে আমি অন্যকারো দখলে সে আমি স্বীকার করি বা না করি।
হিমু ভাই কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, " আমি কেমন আছি জানতে চাইলে না?"
আমি তার দিকে অনেক কষ্টে তাকালাম। কিন্তু চেয়েও সেই দিনের মতো চোখের জল আটকাতে পারলাম না। আজ সাহস করে তার চোখের দিকে তাকালাম, তাকাতেই আমার বুকটা খালি হয়ে গেল। কাল বৈশাখী ঝড় উঠল, হিমু ভাই কাঁদছে! হ্যাঁ আমার হিমু ভাই কাঁদছে। আমার জন্য কাঁদছে।
আমার বুকের ভেতরটা তোলপাড় শুরু হলো।
বললাম, " কত কল দিয়েছি ধরেননি কেন?"
হিমু ভাই কেমন যেন হাসল। বললেন, "এখন এসব বলে কি হবে বিয়ে করে নিয়েছো তো। আমার উপর খুব রাগ তাই না?"
আমি শুধু অশ্রুপাত করলাম কিছু বললাম না। হিমু ভাই হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছলেন। ফর্সা মুখটা লালা হয়ে গেল তার। সেই মুহূর্তে একটা কথাই মনে হলো আল্লাহ কেন আমাদের সাথে এমন করলেন! খুব কি ক্ষতি হয়ে যেত আমরা এক হলে!
হিমু ভাই বললেন, "সবুজ খামটা খোলনি তাই না জোনাকি?"
আমি অবাক হয়ে তাকালাম তার দিকে অভিমানের সুরে বললাম, "কেন খুলবো? আমার টাকার অভাব হয়নি তাই খুলিনি।"
সে শান্ত গলায় বলল, "সাধে কি তোমায় বাচ্চা বলতাম। আসলেই তুমি বাচ্চা। আজও বড় হলে না। ভালোবাসি শব্দটা শুধু মুখে বললেই হয় তাই না জোনাকি? না বললে কেউ বুঝে না। আজ না নিজের গালে নিজেই চড় দিতে ইচ্ছে করছে। সেদিন টাকার কথাটা না বলাই উচিত ছিল। আমি তোমার চোখ কান্না দেখে ভেবেছিলাম তুমি বুঝবে তুমি বড় হয়েছ। কিন্তু না তুমি আসলেই বাচ্চাই রয়ে গেছো। যেহেতু সেটা খোলনি এতদিন। এখন আর খুলো না। থাক না বন্দী আড়ালে সবুজ খামে না বলা কথা।
হিমু ভাই কাঁদছেন কান্নার ধমকে তার শরীর কাঁপছে। তার প্রতিটি কথা আমাকে শেষ করে দিচ্ছিল। তার যন্ত্রণা আমার যন্ত্রণাকে বাড়িয়ে দিচ্ছিল হাজার লক্ষ গুণে। আমার ইচ্ছে করছিল উড়ে গিয়ে সে খামটা খুলে দেখি। আতিফ আসলে যতটা সম্ভব দুজনে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করি।
খাওয়া শেষে বাসায় আসার সময় হিমু ভাই বললেন, " ভালো থেকো জোনাকি, নতুন জীবনের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা। "
হিমু ভাই চলে গেলেন। সাথে নিয়ে গেলেন এক বাচ্চা মেয়ের দেয়া অবুঝপনার কষ্ট। কতটা গভীর ক্ষত সেটা হয়তো বলে শেষ করা যাবে না। একজন সঙ্গে সফল ডাক্তারকে কেমন অসহায় দেখাচ্ছিল। আতিফ আমাকে বলেছিল হিমু ভাইয়ের ভালোবাসার গল্প, শুধু হিমু ভাইয়ের নামটা বলেনি। তাই হয়তো আমি বুঝতে পারিনি হিমু ভাইয়ের অবুঝ বউটা আমিই ছিলাম। আতিফ বলেছিল, হিমু ভাই নাকি সবসময় তার অবুঝ বউয়ের কথা বলতেন। এমন একদিন ছিল না। যেদিন নাকি তিনি তার অবুঝ বউয়ের কথা বলতেন না। আসলেই তার বউটা অবুঝই, নয়তো কেন সে এতদিনেও সে খামটি খুলে দেখল না। কেন তার ভালোবাসা বুঝল না।
বাসায় গিয়ে সবুজ খামটা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। খুলে দেখলাম একটা চিঠি।
জোনাকি
এভাবে তাকাও কেন আমার দিকে, বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে যে আমার। তোমার চাহনিতে মাদকতা আছে জোনাকি যা আমাকে শান্তিতে থাকতে দেয় না। তোমার জ্বরের সেই রাতটিতে তোমার হাত ধরে বসে ছিলাম সারারাত। তোমার মনে আছে জ্বরে ঘোরে তুমি কি বলেছিলে?
বলেছিলে আমাকে ভালোবাসো আমি কেন বুঝি না। সেদিন ইচ্ছে করছিল বিয়ে করে নিজের করে নেই তোমাকে, বলে দেই কতটা ভালোবাসি। কিন্তু পারিনি, কি করেই বা বলব বলো? দুদিন পর আমার ফ্লাইট দুদিনে তোমার কষ্ট বাড়াতে চাইনি। তোমার মনে আছে জোনাকি আমি মাঝে মাঝে তোমার দাদুর সাথে দেখা করতে যেতাম আসলে আমি তোমাকে দেখতে যেতাম। কিন্তু আফসোস তুমি সামনে আসতে না।
প্রতিবার এক বুক যন্ত্রণা নিয়ে ফিরে এসেছি আমি। তুমি যে এত অভিমানী হবে জানতাম না। আমাদের বাড়ি আসার পর কতবার যে তোমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছি তার কোনো হিসেব নেই। তোমার এলোমেলো ঘুমানো, অভিমানী কান্না কিছুই আমার চোখ এড়ায়নি। আমি তোমার চেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছি। তুমি তো কান্না করতে পারো জোনাকি কিন্তু আমি তো তাও পারি না। তবে শোন আমি তোমাকে আর একটু কষ্ট দেব। আমেরিকা যাওয়ার পরও তোমার সাথে কোনো যোগাযোগ রাখব না।
তোমার সাথে কথা বললে আমি সেখানে থাকতে পারব না রত বছর। তার চেয়ে তুমি অপেক্ষা করবে আমার জন্য, আমি চার বছর পর এসে সোজা তোমাকে বিয়ে করে বাড়ি নিয়ে যাব। প্লিজ রাগ করো না লক্ষীটি। তোমার সব অভিমান সুদে আসলে ফিরিয়ে দেব আদর ভালোবাসা দিয়ে। আর চার বছর অপেক্ষা করো বাচ্চা বউটা আমার। অনেক ভালোবাসি তোমায়। অনেক, অনেক বেশি।
ইতি
তোমার ছোট বেলার স্বামী হিমু
চিঠিটা পড়তে পড়তে দম আটকে আসছিল আমার। মনে হচ্ছিল নিজেকে নিজে মেরে দেই। নিজের কষ্টটাকেই সবসময় বড় করে দেখেছি আমি। কিন্তু হিমু ভাইয়ের যন্ত্রণা যে কত লক্ষ গুণ বেশি ছিল তার টেরও ফেলাম না। মনে হচ্ছিল আমার বুকের ভেতর কেউ হাজার হাজার তির মারছে। ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে আমার ভেতরটা। হঠাৎ আতিফ দরজা ধাক্কাচ্ছে চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে বের হলাম।
আতিফ বলল, "হিমালয় বাসায় ফেরার সময় এক্সিডেন্ট করেছে। স্পট ডেট। "
কথাটা শুনে আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। ঘড়ির কাঁটা থমকে গিয়েছিল। হিমু ভাই নেই, আমার হিমু নেই! আমার উপর অভিমান করে চলে গেছে অনেক দূরে। তার সবুজ খামের না বলা কথা, না পড়ার অপরাধ যে কতটা মারাত্মক ছিল তা আমি বুঝতে পেরেছি, তাই সে আমাকে শাস্তি দিয়ে গেছে। কঠিন শাস্তি। আমার উপর অভিমানের পাহাড় বুকে নিয়ে চলে গেছে আমার হিমু। ইয়া আল্লাহ! কোনো মেয়ে যেন আমার মতো অভিমান করে এমন ভুল না করে। এমন হিমালয়কে পেতে যে ভাগ্য লাগে। আমার মতো অভাগী যেন কেউ না হয়। জোনাকিদের অপরাধে যেন কোনো হিমুর মৃত্যুদণ্ড না হয়। আমার হিমু ভাই নেই। কোথাও নেই। আছে শুধু আমার বুকের ভেতর। আর আছে তার সবুজ খামের না বলা কথা।
সমাপ্ত। #সমাপ্ত