ছাড়তে হবে সাধের ঘর বাড়ি ও মন জাননি | Charte Hobe Sader Ghor Bari O Mon J...

#সন্ধ্যা_নামার_পরে
#দুই
পুরোটা পথ বাবাকে নিয়ে নানা চিন্তায় কেটেছে। লোকটার সাথে একটা কথাও হয়নি। অর্নব কাকে যেন কল করে গাড়ি থামিয়ে কথা বলে নেয়। আমার শুধু এই মুহূর্তে এটাই মনে হচ্ছে বাবার কিছু হবে নাতো? আমার জীবন এই একটা দিন আগে যেমন ছিল, তেমন হয়ে যাবে তো? হয়তো আমি চাইলেও আর অনেক কিছুই আগের মতো করতে পারব না। সবচেয়ে বেশি যেটা আগের মতো হবে না। সেটা আমার নাম। এখন আমি একজনের স্ত্রী সে মানি আর না মানি। সমাজ কখনো এই ট্যাগ থেকে আমাকে পালাতে দেবে না। যদি অর্নবের সাথে আমার ডিভোর্সও হয়ে যায় তাও আমার নামের পাশে তার স্ত্রী ট্যাগটাই থাকবে। হয়তো তখন স্ত্রীর সাথে প্রাক্তন শব্দটা জুড়ে যাবে।
★★★
চট্টগ্রাম এসে সবার প্রথমে হাসপাতালে এসে বাবার টেস্ট গুলো করানো হলো। রিপোর্ট তিনদিন পর দেবে তাই আমি ডাক্তার সাহেবকে বললাম, "আমরা এখন বাড়ি চলে যাই। তিনদিন পর আসা যাবে। এ পর্যন্ত আমাদের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।"
অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে সে আমাকে আরেকটি ধমক দিয়ে বলল, "তোমার কী মনে হচ্ছে তুমি আবার অসুস্থ মানুষটাকে টেনেহিঁচড়ে বাড়ি নিয়ে যাবে? যদি তোমার ইচ্ছে হয় তবে চলে যাও। উনি কোথাও যাচ্ছেন না। কারণ একজন ডক্টর হয়ে আমার রোগীর ক্ষতি আমি কাউকে করতে দেব না। যদি সে রোগীর মেয়েও হয় তাও না।"
লোকটা আমায় আবার আটকে দিল। সে জানে বাবাকে আটকে রাখলে আমিও থাকতে বাধ্য হব। তাই সেটাই করল। ইচ্ছে করছিল মুখের উপর কয়টা কথা শুনিয়ে দেই। কিন্তু বাবার কথা চিন্তা করে সেটা আর করা হলো না। আমার উপর রাগ করে যদি বাবার কোনো ক্ষতি করে দেয়! কিন্তু অন্য একটা বিষয় আরও অদ্ভুত লাগল তার সাথে আমার প্রায় চার বছরের চেনা-জানা হতে পারে তা খুব বেশি নয়। তাও সবসময় গ্রামে আসলেই আমাকে পড়াশোনার কথা বলতেন। জীবনে বড় হওয়ার জন্য অঅনুপ্রেরণা দিতেন কিন্তু এখন কেন এমন করছেন। আমি তো তার জীবন থেকে সরে যাব বলেছি। কিন্তু সে কেন আমাকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছে। নানা ভাবনায় কান্না যেন দলা পাকিয়ে গলায় আটকে আসছিল। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিলাম।
★★★
একটা দো'তলা বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামল। বাবাকে নিয়ে ভয়ে ভয়ে অর্নবের পিছুপিছু সামনে এগুতে লাগলাম। বাড়িতে ঢুকতেই দেখলাম একজন প্রোঢ়াসহ চারজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। বয়স্ক ভদ্রমহিলাটির পরনে সাদা জামদানী শাড়ি। চুলগুলো পাট করে আঁচড়ানো। চোখ জোড়া ভীষণ সুন্দর। বয়সের ভারে গায়ের চামড়া কুচকে গেলেও যৌবনে যে তিনি কতটা সুন্দরী ছিলেন তা আজও দেখলে পরখ করে বলা যায়। আজও তার চেহেরায় সেই উজ্জ্বলতা রয়েছে। এক দেখায় চোখ আটকে গেল আমার। বুঝতেই পারলাম না আরও কয়েকজন আমার সামনে দাঁড়িয়ে। অর্নব এক এক করে সবার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল। বাবা ইশারা করল বড়দের সালাম করতে। বৃদ্ধার ডানদিকে দাঁড়ানো অর্নবের মা। তার পাশে অর্নবের বাবা। আর বামপাশে আমার বয়সী পুতুলের মতো দেখতে তার বোন। মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, "ওয়েলকাম হোম ভাবী।"
 
তার ভাবী ডাকে তাজ্জব বনে গেলাম। এ বিয়েটাকে আমি মানি না। তার সাথে কোনো সম্পর্কেও আমি মানি না। ভাবলাম বলব এই মেয়ে তুমি সুন্দর। তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে কিন্তু একদম এসব ভাবী বলে ডাকবে না। আমি মোটেও তোমার ভাবী নই। কিন্তু বলতে পারলাম না। কিছু বলতে যাব তার আগেই পায়ে কেউ এত জোরে চাপ দিল যে ব্যথায় কুকড়ে উঠলাম। বুঝলাম ওই বজ্জাত ডাক্তারের কাজ। ধৈর্য ধরে চুপ করে রইলাম। 
 
বৃদ্ধা মহিলাটি রাশভারি গলায় আমাকে বললেন, "জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে তিন বিধাতা নিয়ে বলেই আমি বিশ্বাস করি। আমার দাদু ভাইয়ের বউ দেখার অনেক শখ ছিল আমার। কিন্তু তার বিয়েটা এমন অদ্ভুতভাবে হবে বুঝতে পারিনি। বউ হিসেবে তোমাকে পছন্দ হয়েছে কিনা সেটা এত অল্প সময়ে বুঝতে পারছি না। খুব তাড়াতাড়ি বুঝতে পারব আশাকরি।"
 
উনার কথার মাঝখানে মধ্যবয়সী মহিলাটি হনহনিয়ে উপর তলায় চলে গেলেন। বৃদ্ধা আবার বললেন, "তোমার শাশুড়ি রাগ করেছেন। সে এমনি হুটহাট রাগ করে আবার সে রাগ চলেও যায়। আসলে তার বড় একটা আশায় জল ঢেলে দিয়েছো তুমি। তাই একটু শক্ত হবে তার রাগ ভাঙানো। তবে চেষ্টা করলেই পেরে যাবে। আমার বউমা ভালো মানুষ। আশাকরি বুঝতে পেরেছো।" তিনি এটুকু বলে দম নিলেন।
তারপর আবার বললেন, "আর হ্যাঁ আমাকে অর্নব দিদান বলে ডাকে। তুমিও তাও ডেকো। এখন যাও ওহি তোমাকে ঘরে নিয়ে যাবে। তোমার বাবাকে জাফর মানে তোমার শ্বশুর নিয়ে যাবে। উনার দিকে আমরা সবাই খেয়াল রাখব। তুমি চিন্তা করো না।"
 
সবার এত সহজভাব দেখে আমি শুধু অবাকই হচ্ছি। ভেবেছিলাম এরা আমাকে মেনে নেবে না। কিন্তু এখানে এসে দেখছি সব উল্টো। এই অসভ্য ডাক্তার তাহলে তখন ফোনে এদের সাথেই কথা বলছিল। আমি তো তাকে বলেছি ডিভোর্স দেব। তাহলে বাড়িতে বিয়েটার কথা না জানালেই পারত। কেন জানাল! ইচ্ছে করছে লোকটার মাথা পাঠিয়ে দিতে। এসব ভাবতেই ওহির কথায় হুস ফেরে।, "চলো ভাবী তোমার ঘরে নিয়ে যাচ্ছি।"
 
ওহিকে অনুসরণ করে সামনের দিকে যেতে নিলেই দিদান পিছু ডেকে বললেন, "তোমার ঘরে খাটের উপর শাড়ি রেখে এসেছি। গোসল সেরে পরে নিবে। আমি আসছি একটুপর।"
আমি উপর নিচ মাথা দোলালাম। ওহি আমাকে দোতলার দক্ষিণের একটা রুমে নিয়ে আসল। রুমটার চারপাশ দেখলাম একটা খুব সুন্দর খাট। চারপাশের দেয়াল গুলো নীল, জানালার পর্দা থেকে শুরু করে বিছানার চাদর সবকিছু সাদা। মনে হলো আমি নীল সাদার দুনিয়ায় এসে গেছি।
ওহি আমার দু'কাঁধে হাত রেখে বলল, "এটা ভাইয়ার রুম। আজ থেকে তোমারও। এ বাড়িতে সবচেয়ে সুন্দর ঘর এটা। আশাকরি এখন থেকে আরও অনেক বেশি সুন্দর হয়ে যাবে। কারণ এর দ্বায়িত্ব নেয়ার মানুষ এসে গেছে।"
 
ওহি মেয়েটা এত দারুণ করে কথা বলে যে শুনতে খুব ভালো লাগে। ওহি বিছানার উপর থেকে তিনটা শাড়ির মধ্যে মেরুন রঙের শাড়িটি তুলে আমাকে দিয়ে ওয়াশরুমটা দেখিয়ে দিল। এ কয়দিনের ধকলের পর লম্বা সময় ধরে ফ্রেশ হতে পেরে ভালো লাগছিল। 
 
কিন্তু আমার সাথে যা ঘটছে তা কেমন এলোমেলো লাগছিল। সব এত সহজে কীভাবে হয়ে যাচ্ছে বুঝতেই পারলাম না। আমার মতো মধ্যভিত্ত পরিবারের মেয়েকে তারা কীভাবে এত সহজে গ্রহণ করল মাথায় ধরল না। কেউ না কেউ তো ভিলেন থাকার কথা। দরজা থেকে আমাকে বের করে দেয়ার কথা। অদ্ভুত ব্যাপার এমন কিছুই হলো না। তবে যে যাই বলুক কেউ ভিলেন নেই তো কী হয়েছে আমি ভিলেন হয়ে বের হব। কারো দয়ার বিয়েতে আমি থাকতে পারব না। নানারকম চিন্তা করতে করতে শাড়ি পরে ওয়াশরুম থেকে বেরুতেই অবাক হয়ে গেলাম। রুমে ছিল ওহি, এখন দেখি ওই অসভ্য ডাক্তারটা দু'হাত উপরের দিকে মেলে পা'দুটো নিচের দিকে ঝুলিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। ভাবছিলাম ওহিকে শাড়ির কুচি গুলো একটু ধরতে বলব। এখন দেখি সে নেই। 
 
এ কয়দিন অনেক জ্বালিয়েছে এ লোক। একে একটা শিক্ষা দেব বলেই ঠিক করেছি। এখন যেহেতু একা পাওয়া গেছে সুযোগ কাজে লাগানো উচিত। তাই কাঠকাঠ গলায় বললাম, "আপনাকে আগে দেখে তো এমন ক্যাটক্যাটে মনে হয়নি। বিয়ে করেছেন মানে কী উদ্ধার করে ফেলেছেন যে প্রতি কথায় কথায় আমাকে ধমক দেন?"
 
সে উঠে বসে আমাকে ভালো করে দেখে শান্ত গলায় বলল, "এই তুমি না অনার্সে পড়। এতটাও বাচ্চা নও যে এমন ছেলেমানুষী করবে। তাছাড়া খুব টায়ার্ড আমি। একদম বকবক করবে না।"
কী ব্যাপার এখন একে এত শান্ত দেখাচ্ছে কেন! কোনো মতলব আছে নাকি। ওহি কোথায় গেল। এ বজ্জাত লোক আমাকে একা একটা ঘরে দেখেই সে মিষ্টি শান্ত গলায় কথা বলছে। আচ্ছা এবার বুঝতে পেরেছি। নিজে সচেতন হয়ে বললাম, "শুনুন আপনার বাসায় সবাইকে বলে দিন। এটা কোনো বিয়ে নয়। আমার খুব ইচ্ছে প্রেম করে বিয়ে করব। সব মাটি হয়ে গেল। এ বিয়ে আমি কিছুতেই মানি না। বাবা সুস্থ হয়ে গেলে চলে যাব।"
 
আমি কী এমন বললাম জানি না। মানুষটা আমার দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে বলল, "বাহ! এদিকে তো দেখি টনটনে জ্ঞান। প্রেম করে বিয়ে করবে! তা করো না কে বারন করছে। এখন অন্তত তোমার কথার মেশিনটা বন্ধ রাখো। এটা তো চলতে শুরু করলে থামে না।"
 
"এই শুনুন বিয়ের পর থেকে আমি যাই বলেছি ধমক দিয়ে গেছেন। কোথায় আমি বেশি কথা বলেছি?"
"আচ্ছা স্যরি তোমাকে বকার জন্য। বিশেষ করে গায়ে হাত তোলার জন্য। আসলে সবকিছু নিয়ে এত চিন্তায় ছিলাম যে কোনোকিছুই তখন মাথায় ছিল না।"
"আচ্ছা ঠি আছে। কিন্তু আমাকে একটা কথা দেন আপনি সবাইকে আজই বলে দিবেন আমাদের বিয়ে হয়নি।"
 
"বিয়ে হয়নি বলছো?" আমার দিকে ভ্রুকুচকে তাকিয়ে বলল।
"গ্রামের মানুষ জোর করে বিয়ে দিলেই বিয়ে হয়ে যায় নাকি। তাছাড়া আমি আপনার যোগ্য না।"
"প্লিজ নিরা একটু চুপ করবে? পরে এসব নিয়ে কথা হবে। এখন শাড়ি ধরে দাঁড়িয়ে না থেকে ঠিক করে পরো। আমি ওহিকে ডেকে দিচ্ছি। ঠিক করে শাড়িটাও পরতে শিখনি।"
আমার আর কোনো কথা না শুনে সে হনহনিয়ে বেরিয়ে চলে গেল। ওহি এসে বলল, "ভাবী আমাকে ডেকেছো?"
"হুম কুচিগুলো ধরে দেয়া যাবে?"
"কেন যাবে না ভাবী সাহেবা। কিন্তু এটা তুমি আমাকে দিয়ে না করিয়ে তোমার বরকে দিয়ে করালেই বেশি ভালো হত। ভেবে দেখো তো কী রোমান্টিক হত। উফ আমার তো ভাবতেই ভালো লাগছে।"
আমি অবাক হয়ে ওহির দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, "কী সব বলছো? উনি কেন আমার শাড়ি ঠিক করে দিবেন!"
"সে তোমার বর বলে।"
 
এ মেয়ে কী পাগল নাকি বুঝলাম না। কী সব বলে যাচ্ছে। তাই আর কথা বাড়ালাম না। চুপ করে শাড়ি ঠিক করলাম। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখলাম। ছোট বেলায় মা মারা যাওয়ায় শাড়ি খুব একটা পরা হয়নি। আজ যেন আমাকে অনেকটা আলাদা দেখাচ্ছে। এমন সময় দিদান আসলেন আমাকে কাছে টেনে চিবুক ধরে বললেন, "তুমি বেশ রূপবতী। আশাকরি আমার দাদু ভাইকে সামলে রাখতে পারবে।" ভদ্রমহিলার কথা শুনে বার কয়েক ঢোক গিললাম। এ পরিবারের সবাই পাগল কিনা আমার সন্দেহ হলো। উনি আমার হাত টেনে এক জোড়া মোটা বালা পরিয়ে দিয়ে বললেন, "আমাদের খানদানি বালা। বিয়ের সময় আমার শাশুড়ি আমাকে দিয়েছিলেন। আমি তোমাকে দিলাম। অযত্ন করবে না। "
 
দিদানের কথায় আন্তরিকতার ঘাটতি নেই। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো এরা এত ভালো কেন! শুনেছি বড়লোকেরা ভালো মানুষ হয় না। কিন্তু এরা সবাই খুব ভালো। শুধু এক ওই ডাক্তার ছাড়া। হঠাৎ দেখলাম একটা সুন্দরী মেয়ে ঘরের ভেতর ঢুকল। দিদানের দিকে তাকিয়ে বলল, "অর্নব কোথায় দিদান?"
দিদান হেসে বললেন, "আরে দিয়া যে। এসো বসো। অর্নব আমার ঘরে আছে। এখনি চলে আসবে।"
মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, "বাহ! মেয়েটা তো খুব সুন্দর দেখতে। কে ও দিদান?"
দিদান বললেন, "অর্নবের বউ।"
 
হঠাৎ মেয়েটার হাসি মুখটায় অন্ধকার নামল। চিৎকার করে বলল, "হোয়াট?"
মেয়েটার চোখেমুখে স্পষ্ট ব্যাথার ছাপ দেখতে পেলাম। আমার বুঝতে দেরি হলো না এ কে। তারপরও নিশ্চিত হতে ওহিকে জিজ্ঞেস করলাম, "উনি কে?"
 
উত্তরটা এলো দরজার সামনে থেকে অর্নব উত্তরে বলল, "আমার বাগদত্তা।"
চলবে....

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url