Kashu Dalal - কাসু দালাল | Bangla New Natok | Chanchal Chowdhury | Shah...

Kashu Dalal - কাসু দালাল | Bangla New Natok | Chanchal Chowdhury | Shah...

ধুমধাম শব্দ করে দরজা ভেঙে ফেলা হয়েছে। খিক-খিক ধরণের অদ্ভুত আওয়াজ করতে করতে প্রাণীগুলো উপরে উঠে আসছে। ইতোমধ্যে তাদের একজন তিনতলায় উঠে এসেছে। এবার কাঠের দরজা ভেঙে ফেলতে পারলেই ভেতরে ঢুকে যাবে। মেজর জোবায়েদ অসহায় চোখে দরজাটার দিকে তাকালেন। শক্ত কাঠের দরজা। ভেতর থেকে লক করা আছে। তবে এটা চোখের পলকে উপড়ে ফেলা প্রাণীগুলোর জন্য ডালভাত। আমরা নির্ঘাত মারা পড়তে চলেছি। পালানোর সব পথ বন্ধ। এবার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করার ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
দরজায় প্রথম ধাক্কাটা পড়তেই মেজর জোবায়েদ আমাকে হেঁচকা টান দিয়ে দেয়ালের কাছে নিয়ে গেলেন। জানালায় টানানো বিশাল পরদার আড়ালে আমরা গা ঢাকা দিলাম। তখনই বিকট শব্দে দরজা ভেঙে গেল। সঙ্গে সঙ্গে একটা বিশাল প্রাণী, যার পা দু'টো ব্যাঙের মতো, হাতদু'টো যেন মানুষের কঙ্কালের, মুখটা বর্ণনা করার মতো নয়। টকটকে লাল চোখদু'টো চঞ্চল। প্রাণীটা হাত ও পায়ের উপর ভর করে এগিয়ে এসে এই বিশাল ঘরের মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে পড়ল। ঠিক মানুষের মতোই সোজা হয়ে দাঁড়াল। চারপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। পুরো বাড়িটাই এখন নিঃস্তব্ধ। প্রাণীটা স্থির দাঁড়িয়ে কান পেতে রইল। কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায় কি না সেটা শোনার চেষ্টা করল। আওয়াজ না পেয়ে ভীষণ রাগে টেবিলটা উলটে ফেলে দিলো। কাচের বাসনগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলল। দেয়ালে টানানো টেলিভিশনটা আছাড় মেরে মেঝেতে ফেলে দিলো। তারপরও যখন কাউকে পাওয়া গেল তা তখন চাপা গর্জনে ফেটে পড়ল।
গর্জনের আওয়াজ খুব বেশি উঁচু নয়। তবে খুব ধারালো। খা-আ-আ-খ-খা-আ-আ.. এরকম শব্দ তৈরি করে চেঁচাতে থাকল প্রাণীটা। তারপর পুরো ঘর ওলট পালট করে দিয়ে কাউকে না পেয়ে ধীরে ধীরে জানালার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। জানালার কাছে পাতলা পরদার আড়ালে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। সেটা কি টের পেয়ে গেছে!
ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে এল।
প্রাণীটা এদিকেই আসছে। সতর্ক পা ফেলে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। আমরা নিরুপায় হয়ে মৃত্যুর কাছে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলাম। প্রাণীটা খুব কাছে এসে পরদায় নাক লাগিয়ে শুঁকতে লাগল। এপাশে আমরা। ওপাশে প্রাণীটা। মাঝখানে পাতলা পরদা। এতটা কাছাকাছি আসার পরও বোকা প্রাণী আমাদেরকে টের পায়নি। গন্ধ শুঁকে নিয়ে ফের ঘরের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর আরো অনেক্ষণ দাপাদাপি করল। সেটা যখন ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল তখনও মেজর জোবায়েদ নড়লেন না। কিছু বললেন না। পাঁচ মিনিট কেটে যাওয়ার পরেও না। দশ মিনিট পরেও না।
প্রায় কুড়ি মিনিট পর তিনি পরদার আড়াল থেকে বেরিয়ে বাইনোকুলার হাতে তুলে নিলেন। জানালার বাইরের দিকটা দেখে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন। আমি তাঁর পিছু পিছু ছাদে গেলাম। তিনি বাইনোকুলারে চোখ রেখে অবাক গলায় বললেন, "মাই গড!"
বাইনোকুলারটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, "দ্যাখো!"
আমি দেখলাম অনেক দূরে অদ্ভুত প্রাণীগুলো জড়ো হয়েছে। বললাম, "এরা মিটিং করছে?"
মেজর আমার হাত থেকে বাইনোকুলারটা কেড়ে নিয়ে ফের সেটাতে চোখ রাখলেন। দূরের দৃশ্যটা দেখতে দেখতে বললেন, "এদের একজন মারা গেছে। মৃত সদস্যকে ঘিরে শোক পালন হচ্ছে। এজন্যই আজ এরা দিনের আলোয় এতটা তান্ডব চালিয়েছে। এরপর এরা থামবে না। নিশ্চয়ই আজ রাতে এরা সাধারণের তুলনায় অন্তত দশ গুণ বেশি হিংস্র হয়ে উঠবে।"
"কিন্তু এই প্রাণীগুলো কোথা থেকে এসেছে? এদের নামটাই বা কী? আগে কখনো তো দেখিনি।"
"আগে দ্যাখোনি, এখন দেখে নাও। সবকিছু তো তোমার সামনেই ঘটছে।"
"কিন্তু এগুলো কোত্থেকে এল? আর শহরের চেহারাই বা এতটা পালটে গেল কেন?"
"পাল্টে যাওয়াটাই যে দরকার। সবকিছুই যে পাল্টে যায়। অন্তত কোয়ান্টাম মেকানিক্স তো সেটাই বলে। বিজ্ঞানের এই এক বিশেষ শাখা, যেখানে বলা আছে, ভবিষ্যৎ কেউ কোনোদিন বলতে পারবে না। প্রকৃতি কিছু বিষয় নিজের কাছে রেখে দেয়। কিছুতেই সেসব আগেভাগে জানতে দেয় না।" বলে তিনি আমার মুখের দিকে তাকালেন। অভিজ্ঞ গলায় বললেন, "এই যে আমাকে দেখছো, কিংবা এই যে আমার হাতের এই দূরবীনটা দেখছো। এইসব প্রতি মুহূর্তে পরিরর্তন হচ্ছে। সবকিছুর রং, আকার, আয়তন, ওজন পরিবর্তন হচ্ছে। এখন তুমি যা দেখছো, এক সেকেন্ড পর সেই চিত্রটা আর আগের মতো দেখতে পারবে না। কারণ ততক্ষণে দৃশ্যটা পুরোপুরি বদলে গেছে। যদিও খালি চোখে সেসব বোঝা সম্ভব নয়।"
থামলেন। আমি বললাম, "কিন্তু এরা কী করতে এই শহরে এসেছে?"
"বদলা নিতে এসেছে।"
"বদলা? কীসের বদলা?"
"প্রকৃতির বদলা। এবার প্রকৃতি নিজেই নিজের বদলা নেবে। প্রতিশোধ নেবে। এবং নিতে শুরু করেছেও। ভেবে দ্যাখো, একসময় ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়েছিল। সেসব বাদ দিয়ে যদি আরো কাছাকাছি কিছু চিন্তা করি তবে দেখতে পাব, গত একশো বছরে শহ হাজারো প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে, বহু পশু, বহু পাখি, বহু বৃক্ষ, বহু নদী, নালা, খাল, বহু পাহাড়, বন বিলুপ্ত হয়ে গেছে শুধু মানুষের কারণে। মানুষ নিজেদের জীবন উন্নত করতে গিয়ে প্রকৃতি ধ্বংস করে ফেলছে। গাছ কাটছে, বন উজার করে ফেলছে, প্লাস্টিকের ব্যবহার দিনদিন বাড়াচ্ছে, কলকারখানা বাড়ছে, পাথর তুলছে, বালি তুলছে, বড়ো বড়ো দালান করছে। সৌখিন নামধারী অসচেতন মানুষ সুস্বাদু পাখি খাওয়ার নাম করে রেস্টুরেন্টে বসে অতিথি পাখির মাংস খাচ্ছে। রেস্টুরেন্টওয়ালারা অতিথি পাখি মেরে মেরে রেঁধে দিচ্ছে। বিনিময়ে মোটা অঙ্কের টাকা! আর কী চাই? তারপর মেডি ওয়েস্ট, ই ওয়েস্ট ইত্যাদি ইত্যাদি। সব পানিতে মিশছে। সমুদ্রের জলে যাচ্ছে। মানুষের এই অতি পাওয়ার সাধ পূরণ হচ্ছে ঠিকই, তবে তার পেছনে লোকসান হচ্ছে সমস্ত প্রাণীকুলের। প্রকৃতি হচ্ছে ধ্বংস। তাইতো সবকিছুর পর আজ মানুষ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। একদিন হয়তো গোটা পৃথিবীতে দু'একজন ব্যতীত কেউই বেঁচে রইবে না। সেই দুই-একজনও থাকবে আফসোস করার জন্য। তারা তখন আফসোস করবে আর প্রকৃতির কাছে ক্ষমা চাইবে।"
নিঃশ্বাস ছাড়লেন তিনি। বিদ্ধস্ত গলায় বললেন, "এই প্রাণীগুলো পৃথিবীতে ছিল না। এদেরকে এভাবে তৈরি করা হয়েছে। এটা প্রকৃতির সাথে বাড়াবাড়ি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। এজন্যই প্রকৃতি প্রতিশোধ নিচ্ছে। আরো নেবে।"
"কিন্তু এরকম প্রাণী তৈরি করল কে?"
প্রশ্ন শুনে তিনি আগ্রহ দেখালেন। বললেন, "ড. অর্ণালের নাম শুনেছ?"
"সেই পাগল বিজ্ঞানী? যাকে স্ত্রী খুনের দায়ে গ্রেফতার করা হয়েছিল?"
"হুমম্। লোকটা মেন্টালি সিক। তা না হলে গবেষণার জন্য কেউ নিজের বউয়ের নাভিতে ক্ষতিকর পদার্থ ঢেলে দেয়?"
"লোকটা কি জেল থেকে মুক্তি পেয়েছিল?"
"হ্যাঁ। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে নিজের ঘরে সিক্রেট ল্যাব তৈরি করে সেখানে গবেষণা চালাতে থাকে। বিভিন্ন প্রাণীদের ডিএনএ স্যাম্পল জোগাড় করে কী একটা করছিল সে। হঠাৎ একদিন প্রেস কনফারেন্স ডেকে বলল সে নতুন এক জাতের প্রাণী আবিষ্কার করে ফেলেছে। সেই প্রাণীগুলো মানুষের কাজে আসবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত রেজাল্ট পাল্টে যায়। একদিন রাতে সে ঘুমাচ্ছিল। তখন প্রাণীটা তার ধারালো নখ দিয়ে ড.-এর কলিজা ছিঁড়ে নেয়। দু'টো প্রাণী ছিল। একটা মেল আর একটা ফিমেল। সেই রাতে দু'টোই পালিয়ে গেল। ওরা তখন বিড়ালের সমান। মাসখানেক ওদের খোঁজ মিলল না। হঠাৎ একদিন একটা রেস্তোরাঁর সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়ল, একটা গোরুর সমান প্রাণী হেঁটে যাচ্ছে। সিকিউরিটি গার্ড ঘুমাচ্ছিল। প্রাণীটা মুহূর্তের মধ্যেই সিকিউরিটি গার্ডের ওপর হামলা করে বসল। পরদিন গার্ডটাকে তো পাওয়া গেল। কিন্তু তার হৃদপিন্ডটা কেউ ছিঁড়ে নিয়ে গিয়েছিল।"
"পাগল বিজ্ঞানীটাই তাহলে সব নষ্টের মূল?"
"হুম।"
"আপনি এতসব জেনেছেন কীভাবে?"
"পেপার পত্রিকায় তা-ই এসেছে।"
"এরপর থেকেই শহরে তান্ডব? যার ফলে সবাই ভয়ে শহর ছেড়েছে?"
"হুম।"
"এতসব হয়ে যাচ্ছে, প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন? পুলিশ, আর্মি এরা কীসের জন্য? আমাদের এত ভারী ভারী অস্ত্র কীসের জন্য?"
মেজর গম্ভীর গলায় বললেন, "তোমার কি মনে হচ্ছে তুমি হলিউডের কোনো সিনেমা দেখছো? যদি মনে হয়ে থাকে তবে সেটা এই মুহূর্ত থেকে ভুলে যাও। এটা কোনো সিনেমা নয় যে নায়ক আসলো। হেলিকপ্টার থেকে ধুমধাম গুলি ছুড়ল। তারপর শেষ। এটা রিয়েলিটি। আর রিয়েলিটিতে কিছু করতে গিয়ে অনেক কিছু বিবেচনা করে করতে হয়।"
"যেখানে মানুষরাই বেঁচে থাকতে পারছে না সেখানে কীসের বিবেচনা?"
"কে বলল বেঁচে থাকতে পারছে না? সমস্যাটা শুধু এই শহরেই। প্রাণীগুলো এখনও শহরের বাইরে কোথাও যায়নি। সুতরাং বাইরের সবাই সেফ।"
"তাই বলে এদেরকে প্রশ্রয় দেওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে? সবগুলোকে খতম করে দিলেই তো হয়।"
"হ্যাঁ, হয়। বিমান বা হেলিকপ্টার থেকে এলোপাতাড়ি ফায়ার করা যেতে পারে। বোম্পিং করা যেতে পারে। এতে কী হবে জানো? একে তো এই শহরটা ধুলোয় মিশে যাবে। আর দুই হচ্ছে এখানকার সব প্রাণীরা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বে। যে যেদিকে পারবে চলে যাবে। এতে করে পুরো দেশ হুমকির মুখে পড়তে পারে।"
"তাহলে এখন?"
"এখন কিছু না। ভাবতে হবে। আর ভাবার জন্য আমাদেরকে বেঁচে থাকতে হবে। আমার অভিজ্ঞতা বলছে, এই প্রাণীগুলো আজ রাতে খুব হিংস্র হয়ে উঠবে। তাই আগেভাগে প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে।"
"কীরকম প্রস্তুতি?"
"চলো আমার সাথে।"
"কোথায়?"
"বাইরে। কিছু জিনিসপত্র আনতে হবে।"
"কিন্তু প্রাণীগুলো যদি আবার হামলা করে?"
"সঙ্গে রিভলবার আছে।"
"আপনার কি মনে হয় এই ছোট্ট রিভলবার দিয়ে ওদের ঘায়েল করা সম্ভব?"
তিনি অসহায় ভঙ্গিতে তাকিয়ে বললেন, "এ-ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। এখন গিয়ে জিনিসপত্র এনে না রাখলে রাতে যখন ওরা হামলা করবে তখন কিছু করার থাকবে না। এরচে' চলো সময় থাকতে প্রস্তুতি নিয়ে নেই।"
"কিন্তু আপনি এতটা শিওর হচ্ছেন কীভাবে যে আজ রাতে ওরা হামলা করবে?"
মেজর গম্ভীর গলায় বললেন, "প্রাণীগুলো তোমাকে খুঁজতে এসেছিল। না পেয়ে চলে গেছে। তবে ওরা হার মেনে নেয় না কখনো। দিনের আলোয় চোখে কম দেখে বলে হাল ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু রাতে অবশ্যই আবার আসবে। তোমাকে নিয়ে যেতে আসবে।"
"আমাকে?"
মেজর অভিজ্ঞ গলায় বলল, "হ্যাঁ, তোমাকে। তুমি নিশ্চয়ই কিছু একটা আড়াল করছো। যা শুধু তুমি জানো আর ওই প্রাণীগুলো জানে। এজন্যই ওরা তোমাকে খুঁজতে এসেছিল।"

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url