Emon Bhengechure Bhalo Keu Baseni-Bengali Recitation by Munmun
আশঙ্কা
৩ ও শেষ পর্ব
Trishna Banik
চুপচাপ দাঁড়িয়েই রইলাম আমি। মেঝভাবী সোহাগ কে ফোনের ঐপাশ থেকে কি বলচ্ছে আমি জানি না। তবে সোহাগের উত্তর দেওয়া কথাগুলা কলিজায় এসে লাগতেছে আমার। সোহাগ বলতেছে, তাড়াতাড়ি বাচ্চা নিয়ে নিলে কেমন হয়। ও তাহলে বাপের বাড়িতে আসা যাওয়াতে থাকবে ঘন ঘন। তাছাড়া বাচ্চাটা হলে ও বাচ্চা নিয়েই সবসময় ব্যস্ত সময় পার করবে। আমি নিজের কান কে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম নাহ্। স্বামী - স্ত্রী দুইজনের ভালবাসার পরিশ্রান্ত ফসল একটা সন্তান। অথচ, সোহাগ কি কি ছক আঁকছে সন্তান কে পৃথিবীতে আনা নিয়ে। শুধুমাত্র আমাকে ব্যস্ত রাখতে। আমি তাহলে এখন গলার কাঁটার মত অনেকটাই। চোখ বেয়ে জল পড়ছে। চিৎকার করে কাঁদারও সুযোগ নেই।
সেই রাতে সোহাগ আমার সাথে খুব নরমভাবে কথা বললো। ভালবাসা দেখাচ্ছিলো অনেক। বারবার বলতেছে, বউ অনেকদিন তো হলো আমাদের তাইনা। আমি বললাম কিসের অনেকদিন!
সোহাগ বললো, আরে বোঝনা। এসব তো বউরাই আগে বলে। তুমি জানি কেমন। এবার আমাদের মাঝে কেউ একজন আসুক। আমার খুব বাবা ডাক শুনতে ইচ্ছে করে।
সোহাগের এই অভিনয় দেখে এই মুহুর্তে নিজেকে খুব অসহায় লাগচ্ছে। কি হচ্ছে কেন হচ্ছে এসব। বারবার জবাব চাচ্ছিলাম উপরআল্লাহ্ এর কাছে। আমি তো জ্ঞানত কোন অন্যায় অপরাধ বা কারো কোন ক্ষতি করিনি তাহলে আমার সাথেই কেন হলো। বাবা - মায়ের পছন্দে বিয়ে করলাম। সবাই জানে আমার কপাল গুনে বিয়ে হয়েছে। ভালো বর। ভালো ঘর। ভরা সংসার। বর দেখতেও উঁচা লম্বা। সুন্দর গড়ন। কিন্তু ভিতরের খবর আর কে জানে।
আমি পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে আমার শাশুড়ি আম্মাকে বললাম, বাড়িতে যাইতে মন চাইতাছে। কয়টা দিন থেকে আসি আম্মা। কি বলেন।
শাশুড়ি আম্মা উত্তর দেওয়ার আগেই, সোহাগ বলে যে, আম্মা আবার কি কইবো। বাবার বাড়ি যাইবা বলার কি আছে। কবে যাইবা বইলো।
শাশুড়ি আম্মা খালি বললেন যাইয়ো, তবে সোহাগ তোমারে নিয়ে যাইবো আবার দুইদিন থাইকা ও তোমারে লগে নিয়া আইবো। এ বাড়িতে আম্মার কথাই শেষ কথা। বিয়ের পর থেকেই দেখতেছি। সোহাগও আম্মার কথা মত রাজী হলো।
বাড়িতে এসে নানুর সাথে পুরো ব্যপারটা শেয়ার করলাম। নানা মারা যাওয়ার পর থেকে নানু আমাদের সাথেই থাকে। নানুর সাথে আমার বন্ধুসুলভ সম্পর্ক হওয়ায় নানুকে আমি সব ই বলি। আমি আবার বড় নাতনী হওয়ায় নানুর অনেক চোখের মনি। নানু শুনে অনেক দুঃখ করলো। এখন বাচ্চা নিতে মানা করলো। বাচ্চা নেওয়া কোন সমস্যার সমাধান নাহ্। আরো কয়টা দিন সময় নে। সোহাগ আর তোর মেঝ জা কে চোখে চোখে রাখ আরো কিছু দিন। তখন সব ই বুঝতে পারবি কহন কি করা লাগবো। আগে সমস্যার সমাধান কর।
আমি এখন বাচ্চা নিতে চাচ্ছি না এটা আর সোহাগ কে বুঝতে দেই না। প্রতিদিন ভয়ে ভয়ে থাকি। মনের মধ্যে যা চলতেছে তা সোহাগ কোন ভাবে জানতে পারলে এখান থেকে মনে হয় আমার আর মুক্তি নেই। অবিশ্বাস, সন্দেহ নিয়ে কিভাবে একটা মানুষ আরেকটা মানুষের সাথে দিনের পর দিন এক ছাদের নীচে থাকে আমার জানা নেই। তারচেয়েও বড় কথা চোখের সামনে নিজরর স্বামীর এমন স্বভাব কিভাবে চোখ বন্ধ করে কানে তুলা দিয়ে থাকি। অন্যেকে দোষ দেওয়ার আগে নিজেই নিজের কপালরে আমি দোষ দেই। ঐদিক দিয়ে সোহাগ খুব চিন্তায় পরে গেছে। এখনো কোন সুখবর আসতেছে না আমাদের। সোহাগ কবিরাজি বিশ্বাস করে অনেক। আমাকে তাবিজ কবজ এনে দিলো গায়ে পরার জন্য। কি কি জানি জল পড়া, তেল পড়াও আনলো সাথে করে। যেনো তাড়াতাড়ি কোন সুখবর আসে।
আমি তো মনে মনে হাসি। ওর সাথে তালে তাল মিলাই। আসলেই উপরআল্লাহ্ কবে যে মুখ তুলে চাইবে সোহাগ। পরদিন সোহাগ আর আমি উঠানে বসে আছি সন্ধ্যা বেলায়। বড়ভাবীও আসলো আমাদের সাথে গল্প করতে। গরম অনেক পড়ায় হাত পাখা দিয়ে বাতাস করতেছে। মেঝভাবীও আমাদের সাথে যোগ দিলো। বড়ভাবী আমাকে এটা ঐটা নিয়ে মজা করে সবসময়ই। তাই বেশ ফাজলামো করছিলো। মেঝভাবী এর মাঝে হঠাৎ বলে বসলো হে রে ছোট, তুই ঐসব ছাইপাশ ঔষধ পত্র খাওয়া ছাড়বি কবে!
আমার আত্মাটা কেঁপে উঠলো। সর্বনাশ, মেঝভাবীর মাথায় এই কথা আসা মানে এই বুঝি সোহাগ সব জেনে গেলো। আমি মেঝভাবীর দিকে একবার তাকাই সোহাগের দিকে একবার তাকাই। ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছিলো। আমি বললাম কি যে বলো না, কবেই তো ছেড়ে দিয়েছি এসব খাওয়া। সোহাগ একটু পরে ঐখান থেকে উঠে আমার ঘরের দিকে গেলো। আমিও কিছুক্ষণ পর উঠে ওর পিছন পিছন গেলাম। ঘরের কাছে গিয়ে দেখলাম ও পুরো ঘর সহ আমার ব্যাগ তছনছ করে কি যেনো খুঁজতেছে। আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না কিছু।
আমি সোহাগ কে বললাম কি খোঁজ। আমাকে বলো আমি বের করে দিচ্ছি। সোহাগ রাগে আমার দিকে তাকালো। আমি আবারো বললাম, কি হয়েছে। ও তারপরো খুঁজেই গেলো।
বাড়ি থেকে আসার সময় নানু আমাকে একসাথে দুইপাতা ঔষুধ কিনে দিয়েছে। ঐটা আমার বিছানার তোষকের নীচে যে বাঁশের ধাড়ি পাতা হয় ঐটার নীচে লুকিয়ে রেখেছি। প্রতিদিন দুপুরে সময় মত খাই। সোহাগ ঐটা কোথায় খুঁজে পাবে।
কিন্তু সোহাগ ঐটা খুঁজে পেয়েছে কিভাবে কিভাবে জানি। আমাকে আর দেখায় নি। আমি তো রান্নাঘরে কাজে ব্যস্ত ছিলাম। পরদিন যখন দুপুরে খেতে যাবো ঔষুদের পাতা টা নেই। আমি তন্নতন্ন করে চারপাশ খুঁজলাম। সোহাগ দরজায় দাঁড়িয়ে বলেতেছে তুমি কি এটা খুঁজতেছো। সোহাগের হাতে প্যাকেট টা দেখেই আমার চোখ বড় হয়ে গেলো। আমি ধরা পড়ে গেলাম।
এদিক দিয়ে সোহাগ উল্টে আমাকে চোখে চোখে রাখতেছে সবসময়। সাথে মেঝভাবীও। আমি জানতে পারলাম অনেকভাবে মেঝভাবীর সাথে সোহাগের একটা কিছু আছেই অনেক বছর ধরেই। মেঝভাবীর আসলে বিয়ের আগে সোহাগকেই পছন্দ ছিলো কিন্তু আমার শাশুড়ি মেঝভাইয়ার সাথে বিয়ে ঠিক করে ফেলে।
আমার অবস্থা টা এখন এমন যে, কিছু জিনিস জানার পরে ঐটা আর যেমন মন থেকে মুছে ফেলা যায়না তেমনি এই ব্যপারটাও তেমন। একি পরিবারের মধ্যে দুইজনেই থাকবে সবসময়। দেখা হবে। সেটা সোহাগ যতই আমার কাছে ক্ষমা চাক না কেন।
তারপরেও আমি সোহাগকে বলেছি শহরে গিয়ে আমরা আলাদা বাড়ি ভাড়া করে থাকবো ও রাজী হয় না। এটা ঐটা কারন দেখায়। তাছাড়া সোহাগ আমার সাথে যে প্রতারণা করলো এরকম একটা জঘন্য কাজে ও আছে তাহলে আমাকে কেন ওর জীবনে জড়ালো।
যাইহোক, বাড়িতে জানালাম আব্বা- আম্মাকে ব্যপারটা। আমাকে অনেক সাপোর্ট দিয়েছেন। আমার উপর ই ছেড়ে দিয়েছেন আমি কি চাই ফাইনালি। তার কিছুদিন পরেই আমি আমাদের বাড়িতে চলে আসি। দুইবছর ড্রপ দিয়ে ডিগ্রিতে ভর্তি হই আবার আমাদের এখানে সরকারী কলেজে। এদিক দিয়ে সোহাগের সাথে বোঝাপড়া হচ্ছে না কোন ভাবেই। বারবার ওর ঐ ব্যপার গুলা মাথায় ঘুরে। অনেক ভেবে চিন্তে ডিসিশান নিলাম একসাথে এক ছাদের নীচে আর না। সোহাগ তো এত সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র না। তারপরো ফোনে হুমকি ধামকি দিতো। একটা সময় ওর ফোনের হুমকি ধামকিতে আর ভয় পাইতাম নাহ্।
শুধু রাতের বেলা আমার ঘুম আসে না। সারারাত জেগে থাকি। চোখ বেয়ে জল পরে। সবকিছু ভাবি। পৃথিবীতে একদল মেয়ে বরাবর ই অন্য আরেকটা মেয়ের দুঃখ কষ্টের কারন হয়, অন্য আরেকটা মেয়ে দ্বারা লান্চিত হয়। সংসার নষ্ট হয় মনে মনে মরে যায় অনেক আগেই। আমরা মেয়েরা বোধহয় তাঁর নিজের স্বার্থ কে আগে দেখি। সেটা আমরা যখন যে চরিত্রে থাকি তখন ঐ চরিত্রের রোল প্লে করি। সেটা যে কোন সিচুয়েশন থেকেই হোক না কেন। কে কোন পরিস্থিতিতে কতটা কঠিক সময় পার করে নিজের সাথে না হলে পুরোপুরিভাবে কেউ ই বুঝতে পারে না। বাইরের দিক টা উপলব্ধি সবাই কম বেশি করতে পারে কিন্তু ভিতরটা! পোড়া গন্ধ টা কয়জন আর পায়।
আশঙ্কা
৩ ও শেষ পর্ব।