Bangla Poem || Paribona Ekothati Boliona Ar || By Talikng Tom || Bangla ...

Bangla Poem || Paribona Ekothati Boliona Ar || By Talikng Tom || Bangla ...

তিন মাস বোনের সংসারে থাকার পর বের হয়ে গেলাম।ইচ্ছা করে বের হলাম তা না, একরকম ঘাড় ধরে বের করে দিলো। এই তিন মাস যে জীবনটা কাটিয়েছি তারচেয়ে রাস্তার একটা নেড়িকুকুরের জীবনও হয়তো বেশি সুখের।
বাবা মারা যাওয়ার কয়েকদিন পর আমাদের আশ্রয় হয় চাচার বাড়িতে। তখন আমি আর আমার বোন অনেক ছোটো । জীবনে অশান্তির শুরুটা তখন থেকেই। মানুষের বাড়িতে আশ্রিত থাকার চেয়ে অপমান আর লাঞ্চনার জীবন মনে হয় পৃথিবীতে দ্বিতীয়টা নেই।
দাদার যেটুকু সম্পত্তি ছিলো তাতে বাবা তার ভাইয়ের সমান সম্পত্তি পাবে, পাছে সেই সম্পত্তি আবার বেহাত হয়ে যায়, শুধু এই ভয়ে বাবার মৃত্যুর পর চাচা আমাদেরকে তার বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলো। মাসখানেক যেতে না যেতেই বুঝতে পারলাম যে, চাচার সংসারে আমাদের অবস্থান চাকর বাকরের চেয়েও অনেক নিচে। রোজ রোজ ভাতের খোটা,থাকার খোটা, আর এইসব নিয়ে ক্যাঁচাল। অশান্তি যেন নিত্যদিনের সাথী হয়ে গেলো।
এক রাতে সব অশান্তি থেকে মা মুক্তি নিলো স্বার্থপরের মতো। সকালে মার মৃত দেহ ঝুলে থাকতে দেখলাম ঘরের আড়ার সাথে। পাড়া-প্রতিবেশি হাহুতাশ করতে লাগলো, আমিও খুব কান্নাকাটি করলাম, কিন্তু আমার বোন থাকলো অসাড় হয়ে। সে হয়তো কিছু একটা বুঝেছিলো , যা আমি তখন বুঝতে পারিনি।
তবুও চাচার সংসারে থেকেছি প্রায় পাঁচ বছর। চাচাতো ভাইবোন পড়াশোনা করেছে, কিন্তু আমাদের দুজনের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো। আমি জমির কাজ করেছি কামলাদের সাথে, চাষের জমিতে ওদের জন্য ভাত নিয়ে গিয়েছি। গরুর ঘাস কেটেছি। আর আমার বোন করেছে ঘরে আয়া-বুয়ার কাজ।
এরপর বোনের বিয়ে হলো। বিয়ে বলতে কাজী ডেকে কলমা পড়িয়ে দেওয়া আরকি। যার সাথে বিয়ে হয়েছে তার আগেও একটা বিয়ে ছিলো। বউ মারা যাওয়ার পর বংশ রক্ষা আর সংসার সামাল দেওয়ার জন্য আরেকটা বিয়ে। তখন আমার বোনের বয়স অল্প। পাত্র কেমন সে ব্যাপারে চাচার মধ্যে বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিলো না, থাকার কথাও না। আপদ বিদায় করতে পেরে বরং সে যারপরনাই খুশি হয়ে ছিলো।
বিয়ের তৃতীয় দিন বোনের শ্বাশুড়ি যখন দেখলো আমার বাড়ি ফেরার কোনো নামগন্ধ নেই, তখন তিনি বললেন, তোমার চাচার বাড়ি থেকে তো কেউ এলো না তোমাকে নিতে, একা একা যাবে কিভাবে অতোদূর? আমি বললাম, আমি তো আপার সাথে এই বাড়িতেই থাকবো। এই কথা শুনে উনি এতোটা অবাক হলেন যে, আরেকটু হলে স্ট্রোকই হয়ে যেতো মহিলার।
অথচ বিয়ের পাকা কথাবার্তার সময় দুলাভাইর সাথে এভাবেই কথা হয়েছিলো। চাচাই বলেছিলো আমাকে তাদের সংসারে নিয়ে রাখতে। দুলাভাই বলেছিলো, থাকুক, কোনো অসুবিধা নেই। বোনের শ্বাশুড়ি সেদিনের পর থেকে আর কখনোই আমার সাথে হাসিমুখে কথা বলেনি। নিজের চাচা-চাচিই যখন আপন ভেবে হাসিমুখে কখনো কথা বলেনি, তখন এতো দূরের একজন মানুষের কাছ থেকে এতো ভালো ব্যবহার আমি আশাও করিনি।
সপ্তাদুই যেতে না যেতেই আমাকে নিয়ে এবাড়িতে ঝামেলা হতে লাগলো। আমার বোন শুধু কান্না করতো, তর্কে যেতো না। কারণ তার তর্ক করার কোনো সুযোগ ছিলো না। অনাথ একটা মেয়েকে বউ করে ঘরে তুলেছে, এটাই তো আমাদের সাত জনমের ভাগ্য। এর উপর আবার কীসের তর্ক!
তখন সম্ভবত এক মাস হয়েছে ওবাড়িতে। একদিন খাওয়ার টেবিলে আমাকে নিয়ে কথা উঠলো, এক পর্যায়ে আমার বোন বললো, "ও যাবে কোথায়? পৃথিবীতে ওর তো যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। আমি ছাড়া ওর আর কেউ নেই।" এই কথায় বোনের শ্বাশুড়ি বললো, "এটা কোনো এতিমখানা না যে, দুনিয়ার সব এতিম মিসকিন এসে এখানে ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকবে।" দুলাভাইও কিছু বললো না।
বোনের বাসার বাজার করতাম আমি। আনুষ্ঠানিকভাবে আবার শুরু হলো চাকরের জীবন। রোজ কাঁচা বাজার করতে গিয়ে আজিমপুরের দুই-একটা গলি ঘুরতাম।বেশি দূরে যাওয়ার সাহস পেতাম না, পাছে যদি হারিয়ে যাই, এই ভয়ে। দুলাভাইদের বাসাটা ছিলো কামরাঙ্গীর চরে। আস্তেধীরে লালবাগ,বংশাল, আজিমপুর,নিউমার্কেট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আশপাশের এলাকাগুলো চিনতে থাকলাম।
অপমান সইতে সইতে কেমন যেন হয়ে গিয়েছিলাম। রোজ ভাবতাম কাল বাজার করতে গিয়ে আর কোনদিন ফিরবো না এবাড়িতে, দুচোখ যেদিক যায় সেদিক চলে যাবো, কিন্তু বোনের কথা চিন্তা করে পারতাম না। একটু নিরিবিলি পেলে বোন আমাকে বলতো, যে যাই বলুক তুই কিন্তু আমাকে ফেলে কোথাও যাবি না। এই বলে কাঁদতো। পৃথিবীতে ও ছাড়া আমারও আর কেউ ছিলো না।
এর কিছুদিন পর থেকে বোনের সাথে তার শ্বাশুড়ি দুর্ব্যবহার করা শুরু করলো। দিন যতো যাচ্ছিলো এর মাত্রা ততোই বাড়ছিলো। একসময় মনস্থির করলাম, বোনের জন্য হলেও এবাড়ি ছাড়তে হবে। কিন্তু কী করবো? কোথায় যাবো?
একদিন বিকেলে সত্যি সত্যি বের হয়ে আসি। ইতিমধ্যে পলাশি বাজারে এক মাছ বিক্রেতার সাথে সখ্যতা গড়ে উঠেছিলো। সে এক সাইকেল - রিকশা ম্যাকানিকের সাথে পরিচয় করায়ে দিছিলো। তার নাম মকবুল মিস্ত্রি।
এই ম্যাকানিক পেশায় ছিলো মিউনিসিপালিটির ক্লিনার। পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ফুটপাতে সাইকেল আর রিকশা সারাই করে। তার সাথে কাজ করতাম। চাকায় হাওয়া দিতাম, নাটবল্টু টাইট দিতাম, খুলতাম, লিক সারাতাম।
সপ্তাখানেকের মধ্যে বেশ কাজ শিখে গেলাম। পুরোদমে কাজ করতে থাকলাম। বিনিময়ে দুই বেলা খাওয়া পেতাম। রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণের নিচে ফুটপাতে ঘুমাতাম। মকবুল কাকা মানুষ ভালো। আমার সাথে দুর্ব্যবহার করতো না। এই প্রথমবার জীবন অর্থবহ মনে হতে লাগলো।
শুরু হলো নতুন জীবন। মকবুল কাকা বাসা থেকে একটা বালিশ আর একটা কম্বল এনে দিয়েছিলো। রাতে ফুটপাতে পলিথিন বিছিয়ে তার উপর অর্ধেক কম্বল বিছিয়ে বাকি অর্ধেক মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতাম।
এ জীবনটা খারাপ না, ভালোই। অন্তত চাচা-চাচি ছিলো না, কিংবা বোনের শ্বাশুড়িও ছিলো না, তবে চোখ বুজলেই বোনের ছবিটা ভেসে উঠতো। খুব কান্না পেতো। কম্বল মুড়ি দিয়ে কাঁদতাম। বালিশের কাভারটা চড়চড়ে হয়ে গিয়েছিলো চোখের পানিতে। অনাথ একটা মানুষের চোখের পানির আবার মূল্য কী? পৃথিবীতে কিছু কান্নার আসলেই কোনো মূল্য নেই।
এক রাতে আমার সাথে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো। আমি শুয়ে ছিলাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উল্টো দিকে। অর্থাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরীর দিকটাতে। তখন আমরা এইদিকে চলে এসেছি গ্যারেজটা নিয়ে, কারণ এদিকে তুলনামূলক কাজকাম বেশি।
তখন রাত তিনটার মতো বাজে। শুয়ে আছি, ঘুম আসছে না। এমন সময় একটা মেয়ে ছুটে এলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিক থেকে। আমি কম্বলের ভেতর থেকে মাথা বের করতেই সে খুব অসহায়ভাবে আমাকে বললো তাকে লুকানোর জন্য একটু সাহায্য করতে। কারা যেনো তাকে খুন করার জন্য তাড়া করেছে।
আমি তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাকিম চত্বর আর লাইব্রেরির পিছনটাতে লুকাতে বললাম।আমার কাঁধে পা দিয়েই সে বাউন্ডারি পার হলো। আমি তার উপর প্লাস্টিকের কিছু ছেড়া বস্তা আর পাতা দিয়ে ঢেকে দিলাম। এরপর আবার এসে নিজের জায়গায় শুয়ে পড়লাম। এর কিছুক্ষণ পর কয়েকজন লোক এসে আশপাশে খুঁজলো। না পেয়ে অবশেষে চলে গেলো। লোকগুলো যাওয়ার কিছুক্ষণ পর আমি তাকে ডেকে দিলাম।
মেয়েটার বয়স বাইশ-তেইশ বছর হবে। বয়সে আমার চেয়ে অনেক বড়ো। ঠোঁটে গাড়ো করে লিবিস্টিক দেওয়া। কটকটা লাল রঙের। গায়ের রঙটা ময়লা। চিবুকের কাছে একটা তিল। আসল না, আঁকানো। কিন্তু চোখ দুটো অদ্ভুত সুন্দর। মামা মায়া চাহনি।
ময়লার স্তুপে বসেই তার সাথে অনেকক্ষণ কথা বললাম। রাত তখনো শেষ হয়নি, অথচ যতবার আমি মেয়েটার চোখের দিকে তাকিয়েছি আমার মনে হয়েছে, এই টলটলা চোখে জমে থাকা পানিটুকু শুকিয়ে গেলেই আকাশ ফুটো হয়ে সকালের আলো নামবে। মেয়েটা সে রাতে তার সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলেনি,আমিও জানতে চাইনি।
এরপর অনেকদিন আমাদের আর দেখা হয়নি। কিন্তু অবচেতন মনের কোথায় যেন এক মানবীর ছবি সেঁটে গিয়েছিলো। বারবার মনে হয়েছে তাকে বলি, যতবার তোমার চোখে পানি আসবে, ততবারই আমি কদমফুল হয়ে তোমার সামনে আসবো। তোমার অমূল্য ওই চোখের পানিতে সিক্ত হবো। তোমাকে নিয়ে গাইবো প্রণয়ের গান।
একরাতে মেয়েটাকে স্বপ্নে দেখলাম। একটা ছাতিম গাছের ছায়ায় বসে সে আমাকে ভাত বেড়ে দিচ্ছে। জায়গাটা একবারে নির্জন, জনমানবহীন। কয়েকটা ঘুঘু পাখি ডাকছে শুধু। খাবারের আয়োজন সামান্য। ভাত,আলুভর্তা, পাতলা ডাল, ডালভর্তা আর শুকনা মরিচ। নিজে খাচ্ছি আবার মাঝেমাঝে মেয়েটার গালেও তুলে দিচ্ছি।
মাসখানেক পর হঠাৎ একরাতে বৃষ্টি নামে। আমি বালিশ আর কম্বলটা পলিথিনে মুড়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের একটা কংক্রিট ছাউনির নিচে গিয়ে দেখি সেই মেয়েটা ওখানে দাঁড়ানো।
আমি বললাম, কেমন আছেন? সে কিছু বললো না, শুধু একটা হাসি দিলো। সেই হাসির শব্দে মনে হলো বৃষ্টির শব্দটা হঠাৎ নুপুরের শব্দে পরিণত হলো। আমি তন্ময় হয়ে তার সেই হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। মনে হলো বৃষ্টি না থামুক, হাসির রেশ না কাটুক, আমি আমার এই জীবনটা শুধু এই মেয়েটার হাসির শব্দ শুনে কাটিয়ে দেই এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।
এরপর আমাদের প্রায় প্রতি রাতেই দেখা হতো। সারাদিন কাজ করতাম, কিন্তু মনে পড়ে থাকতো এক জোড়া চোখের কুঠুরিতে, যেখান থেকে সূর্য দিঘল বাড়ি দেখা যায়। যে চোখের দিকে তাকালে বুকে সুখের মতো ব্যথা হয়।
টুকটাক করে গল্প করতে করতে একসময় আমরা একে অপরের প্রায় সব কথাই শুনে ফেলেছিলাম। সে আমাকে বলেছিলো তার এই অন্ধকার পথে আসার করুণ গল্প। বলতে বলতে চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তো, আমি মনেপ্রাণে চাইতাম হাত দিয়ে সেই চোখের পানি মুছিয়ে দিতে, কিন্তু পারতাম না।
একপর্যায়ে খেয়াল করলাম মীরা তার অন্ধকার পথটা থেকে বেশক্ষাণিকটা সরে এসেছে। 'মীরা' নামটা আমারই দেয়া। আদর করে আমি এই নামে ডাকতাম। যখনই এই নামে ডাকতাম, ও আনন্দে ঝলমল করতো। সারা জীবন ঘৃণাভরে মানুষ যাকে নটি-বেশ্যা নামে ডেকেছে, তাকে কেউ একজন আদর করে মীরা নামে ডাকছে, এতে ঝলমলে হওয়ারই কথা।
মেঘে-মেঘে অনেক বেলা হলো। গল্প কথার ফাঁকে ফাঁকে মন দেওয়া-নেওয়ার ঘটনাটাও কখন যেন ঘটে গেলো, টের পাইনি।
একসময় মনে হলো এই জনমদুঃখি মেয়েটাকে এভাবে আর নষ্ট হতে দিবো না। হিংস্র কাউকে তার ওই চোখের পানি হতে দিবো না, আমি তার চোখের কাজল হবো। সেই কাজল দিয়ে তার জীবনের প্রতিটা পাতায় লিখবো আনন্দ-অশ্রুর গান।
মকবুল কাকার গ্যারেজের তখন অনেক নামডাক। রিকশাওয়ালারা সোজা চলে আসে এই গ্যারেজে। দুইজনে কাজ করে শেষ করতে পারি না। আমি তখন সব কাজই পারি। দুইবেলা খাওয়ার বাইরেও মাসে চার হাজার টাকা পাই। এছাড়াও টুকটাক হাতখরচ পাই। মাসের বেতন মকবুল কাকার কাছেই জমাই। তিন মাসে মোট সাড়ে বারো হাজার টাকা জমে গেছে।
মীরার কথা মকবুল কাকাকেই প্রথমে জানালাম। কাকা ওর সাথে কথা বললো। আমাদের বয়সের ব্যবধান, ওর পেশা, সমাজ, সংসার সবকিছু মিলিয়ে মীরা প্রথমে অমত করেছিলো, যদিও আমি ভালো করেই জানতাম যে, এটা তার মনের কথা না।
আশ্বিনের এক কালো সন্ধ্যায় মায়াবতী মেয়েটার সাথে জীবন-মরনের রশিটা বেঁধেই ফেললাম। বিয়ে করে রাতে বোনের বাসায় গেলাম বোনের দোয়া নিতে। এর আগে একবার গিয়েছিলাম সবকিছু জানাতে। বোন খুব কেঁদেছিলো আমাকে ধরে। জানিয়েছিলো সে ওবাড়িতে মোটেও ভালো নেই।
কতোটা কষ্টে ছিলো তা বুঝতে পারলাম মীরাকে নিয়ে যাওয়ার পর। রাতে থাকতে বলা তো দূরের কথা, একটু মিষ্টিমুখ করাতেও পারলো না ভাইয়ের নতুন বৌকে। ওর শ্বাশুড়ি নিচে আসেনি একবারো। কিছু কিছু মানুষ পৃথিবীতে শুধু কষ্ট পাওয়ার জন্যই জন্মায়। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমাদের ছোট্ট সংসারে আপাকে নিয়ে রাখবো।
মকবুল কাকা নিজ খরচায় আমাকে একটা কাঠের বাক্সো বানিয়ে দিলো গ্যারেজের জন্য। আমার নিজের একটা গ্যারেজ হলো। গ্যারেজের নাম দিলাম "ঢাকা রিকশা ক্লিনিক"। প্রচুর ইনকাম হতে লাগলো।
আগেই একটা টিনশেড খুপড়ি ঘর নিয়েছিলাম আজিমপুর কলোনির পাশে।ভাড়া দুই হাজার টাকা।বিয়ের পর সত্যি সত্যি আমার ভাগ্য ফিরে এলো। গ্যারেজ থেকে প্রচুর পয়সা আসা শুরু হলো। রোজ দুপুরে মীরা ভাত তরকারি রেঁধে টিফিন ক্যারিয়ারে করে নিয়ে আসতো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ক্যাফেটেরিয়া, ডাকসু, কলাভবন, হাকিম চত্বর বা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বসে দুইজনে খেতাম। রাতে খেতাম বাসায় গিয়ে একসাথে।
একসময় গ্যারেজের পাশে ফুটপাতে রিকশাওয়ালাদের জন্য ভাতের হোটেল খোলার চিন্তা করলাম দুইজনে।একটা ছেলে রাখলাম বাজার সদায় করা আর রিকশায় করে দুই বেলা ভাত তরকারি আনার জন্য। এই কাজের জন্য পুরনো একটা রিকশাও কিনে ফেললাম। সময় পেলে মীরাকে রিকশার পিছনে বসিয়ে দুইজনে ঘুরতে বের হতাম।
যে চিন্তা, সেই কাজ। রিকশাওয়ালাদের জন্য একটা ভ্রাম্যমাণ ভাতের হোটেল দিয়ে ফেললাম।প্রথম প্রথম রিকশাওয়ালারা খেলেও আস্তেধীরে অন্যান লোকজনও আসা শুরু করলো। প্যাকেজ ছিলো দুইটা। ভাত, মুরগি, আলুভর্তা আর ডাল। আরেকটা প্যাকেজও প্রায় একই ছিলো, শুধু মুরগির বদলে মাছ। দাম একই, ষাট টাকা। একটা প্যাকেজ থেকে কুড়ি - বাইশ টাকা লাভ থাকতো সবকিছু বাদ দিয়েও।
আল্লাহর রহমত আর মীরার রান্নার গুণে হোটেলের নাম রিকশাওয়ালাদের মুখে মুখে পুরো ঢাকায় ছড়িয়ে পড়লো। ভাত আনতে আনতেই শেষ হয়ে যেতো। দুই শিফটে রান্নার ব্যবস্থা করলাম। দুই হাতে টাকা আসতে লাগলো। কাজের ছেলেটাকে গ্যারেজে বসিয়ে আমি নিজেই হোটেলের দিকে পুরো মনযোগ দিলাম।
এরমধ্যে মীরার গর্ভে আমাদের ভালোবাসাবাসির ফুল ফুটলো। টিনসেড ছেড়ে আধাপাকা একটা ঘর নিলাম পাশেই। একজন কাজের মহিলা রাখলাম হোটেলের রান্নাবান্না আর হাড়ি-পাতিল ধোয়ামোছার জন্য।
সন্তানসম্ভবা হওয়ার পরপর মীরার চেহারায় যেন পৃথিবীর সব স্নিগ্ধতা ভর করলো। সারাদিন গ্যারেজের কাজ করি, হোটেলে খাবার বিক্রি করি, কিন্তু মন পড়ে থাকে মায়াবতী মেয়েটার চোখের মধ্যে। সারাক্ষণ কাছাকাছি থাকতে মন চায়। হাত ধরে থাকতে ইচ্ছে করে। বুকের মধ্যে জড়িয়ে রাখতে ইচ্ছে করে।
আমার কাছে একসময় মনে হলো, জীবনের শুরু থেকে এতো কষ্ট করেছি যে, সব কষ্ট মনে হয় শেষ হয়ে গেছে। এখন শুধু সুখ আর সুখ। মীরা বললো আপাকে আমাদের সাথে এনে রাখার জন্য।
সব মিলিয়ে জীবনটাকে পরিপূর্ণ মনে হলো আমার কাছে। রাতে যখন মীরাকে বুকের ভেতর জড়িয়ে নিয়ে শুয়ে থাকতাম, তখন আমার মনে হতো, ছোট্ট জীবনে যা পেয়েছি, তাই যথেষ্ট। পৃথিবীর কাছে আমার আর চাওয়ার কিছু নেই।
সময় বয়ে চললো। হঠাৎ একদিন বেলা চারটার দিকে বুয়া আমার গ্যারেজে এসে বললো মীরা ঘরে নেই। দরজা খোলা, কিন্তু তালাও দেয়া না। ঘরের মাল জিনিস সব এলোমেলো। আমি কিছু চিন্তা করতে পারলাম না। মনে হতে লাগলো আমি দাঁড়িয়ে আছি, কিন্তু বাকি পৃথিবীটা মাথার উপর দিয়ে ঘুরছে।
কাজের ছেলেটাকে গ্যারেজে রেখে মকবুল কাকাকে নিয়ে বাসায় গেলাম। যেয়ে দেখলাম ঘরের সব মাল জিনিস এলোমেলো করে রাখা। আমাদের সমস্ত সঞ্চয় ছিলো খাটের পায়ার মধ্যে লুকিয়ে রাখা, সেগুলো সব ঠিক আছে। মীরাই এভাবে রেখেছিলো। তারমানে কী হতে পারে? ভেবে কোনো কূলকিনারা করতে পারলাম না।
রিকশা নিয়ে প্রথমে ঢাকা মেডিকেলে গেলাম। এরপর আশপাশের সবগুলো হাসপাতাল আর ক্লিনিকগুলাতে গেলাম। সম্ভব্য সব জায়গায়ই গেলাম, কিন্তু কোথাও কোনো খোঁজ পেলাম না।
রাত হয়ে গেলো এগারোটা। শেষমেশ মকবুল কাকাকে নিয়ে গেলাম লালবাগ থানায়। ডিউটি অফিসারকে সব খুলে বললাম। সে একটা জিডি ফাইল করলো, কিন্তু ভাব লক্ষণ দেখে মনে হলো না যে, এই শহরের একজন সাবেক পতিতার নিখোঁজ সংবাদ তাকে খুব একটা বিচলিত করেছে।
থানাটা নতুন। একবারে বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষে। সামনে বড়ো একটা উঠোনের মতো। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে বললাম ; খোদা, তুমি আমার এই জীবনের বিনিময়ে হলেও মীরাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও। তাকে ছাড়া এ জীবনের একটা দিনও আমি বাঁচতে চাই না।
আমার এই আকুতি কেউ শুনলো কী না জানি না, তবে একটা কাক করুণ সুরে কা কা করতে করতে মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেলো।
সমাপ্ত

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url