Gittu Salim | গিট্টু সেলিম | Bangla Natok 2017 | Ft Aakho Mo Hasan & Ritu | Juel Hasan

Gittu Salim | গিট্টু সেলিম | Bangla Natok 2017 | Ft Aakho Mo Hasan & Ritu | Juel Hasan

 

গাড়িতে বসে হুট করে খেয়াল করলাম। আমার পাশের মহিলা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
কেমন জানি অস্থির লাগছিল উনাকে৷ ভালো করে খেয়াল করলাম উনি প্রেগনেন্ট। কয়েক জোড়া বাজে দৃষ্টি শকুনের মত তাকিয়ে আছে মহিলার দেহের উপর। 
 
অবস্থা খুব দ্রুত খারাপ হচ্ছে দেখে হেলপারকে ডাক দিলাম। বাসের প্রায় অর্ধেক ভরা লোকজনে।
হেলপার আমার কথা শুনে বললো। উনাকে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে যেতে। আমি কিছু ভেবে উঠতে পারছিনা। বললাম, সামনে কোন হাসপাতাল অব্দি পৌছে দিলে ভালো হত। 
 
তখনই ড্রাইভার সব ব্যাপার বুঝতে পেরে বললেন। আপনি উনাকে নিয়ে অন্য গাড়িতে করে হাসপাতালে চলে যান৷ এই রাস্তায় হাসপাতাল নেই। একজনের জন্য এত জন লোক ঠিকমত যার যার কাজে পৌছতে পারবে না৷ 
 
এই কথা শুনে আমার কি জবাব দেওয়া উচিত সেটাই খুঁজে পেলাম না৷ একজন সন্তানসম্ভবা মা এভাবে কাতরাচ্ছে আর কেউ একটু কথাও বললো না!
কেউ একবারও বললো না, আগে মহিলাকে হাসপাতালে পৌছে দিক! সবাই তো এরকম কোন মায়ের পেঠ থেকেই জন্ম নিয়েছে। 
 
নাকি জীবন মানুষকে এতটাই যান্ত্রিক করে দিয়েছে যে মানবিকতা নামক কিছু হারিয়ে গেছে।
মহিলা আমার পাশে বসা আর মানবিকতার দাবিতে এভাবে ফেলে রেখে কিভাবে ছেড়ে দিই ভাবতেই খারাপ লাগল। 
 
উনি আমার দিকে অসহায় দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছেন।
নেমে পড়লাম বাস থেকে।
জিজ্ঞেস করলাম উনাকে এভাবে এই অবস্থায় একা বের হওয়া তো ঠিক না৷ কেউ আছে সাথে?
উনি কাতরাতে কাতরাতে বললেন সামনের গলি থেকে একজন মহিলা আসবেন। উনাকে নিয়েই বের হবার কথা৷ তাই এদিকে আসছিলেন। শরীর বেশি খারাপ লাগছিল তাই এখানের কোন এক হাতুরে ডাক্তারের উদ্দ্যেশে বের হয়েছেন। 
 
উনার কাছ থেকে ফোন নাম্বার নিয়ে ওই সাথে নিয়ে যাওয়া মহিলাকে কল দিতে লাগলাম।
প্রথমে ২/১ বার কল হচ্ছিল। এরপরে দেখলাম ফোন বন্ধ!
বুঝতে বাকি রইল না আমার। এই পৃথিবীতে অসহায়দের সহায় হওয়ার মত মানুষরা দিন দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে। কেউ ই নিজের স্বার্থ ছাড়া এক পাও এগোয় না। 
 
ওই আন্টি বার বার আমার দিকে তাকাচ্ছেন। জিজ্ঞেসু চোখে। উনার সেই চোখে কারও প্রতি অপেক্ষা প্রতিক্ষা, ভরসায় উৎসুক চোখের ভাষা আমাকে বার বার পীড়া দিচ্ছিল।
আমি অনেকটা মিথ্যে বললাম, ফোন ধরছেন না। বলিনি ফোন বন্ধ করে রেখেছেন কল দেওয়ার পর।
এদিকে আমার টিউশনেরও দেরি হচ্ছে। আগামীকাল স্টুডেন্টের এক্সাম আছে। তাও ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখে দিলাম। 
 
একটা অটো নিয়ে সরকারী হাসপাতালের দিকে ছুটলাম।
উনার বাড়িতে কে কে আছে জানতে চাইলে হাত নেড়ে বললেন, একটা ছেলে আর কেউ নেই।
আধাঘন্টার মধ্যে আমরা হাসপাতালে পৌছে গেলাম।
বেডে শুয়াতে একটু নিশ্বাস ফেলে বললেন। ফোনের উনার ছেলের নাম্বার আছে। কল দিতে। যেন চলে আসে এখানে। 
 
ফোনটা নিয়ে কল দেওয়ার মাঝেই ডাক্তার আমার হাতে একটা প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দিলেন।
দ্রুত মেডিসিন গুলো আনতে বললেন। এই জরুরি অবস্থায় জানার দরকার পড়েনি আমি রুগির কে!
আমি প্রেসক্রিপশন হাতে এগুতে এগুতে ফোন দিলাম।
আওয়াজ শুনে মনে হলো। বড়জোর ১১/১২ বছরের বাচ্চা হবে। আমি লোকেশন বলে দিয়ে ফোন রেখে দিলাম। 
 
ফার্মেসিতে এসে ব্যাগ হাত দিতেই মনে পড়ল। ৮০০ টাকা আছে আমার কাছে৷ দু-একটা জবের এপ্লাই করব বলে টাকা নিয়ে বের হয়েছিলাম আজ। না হলে এত টাকা থাকে না আমার মত স্টুডেন্টের ব্যাগে।
মাস্টার্সে পড়ুয়া ছাত্রী আমি৷ একটা চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছি। 
 
আর কিছু না ভেবে সেলাইন সহ দরকারী মেডিসিন আরও ২০০ টাকা ফেরত নিয়ে আবার হাসপাতালে ঢুকলাম।
ততক্ষণে ছেলেটা তার মায়ের কাছে পৌছে গেছে। হয়ত আশেপাশে কোথাও ছিল। তাড়াতাড়ি চলে এসেছে। 
 
আমাকে দেখে দৌড়ে এসে কেমন করে তাকিয়ে থাকল অনেকক্ষণ। ততক্ষণে ডাক্তার ওর মাকে ডেলিভারি রুমে নিয়ে চলে গেছে।
চুপচাপ কিছু না বলে ডেলিভারি রুমের দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। কেমন জানি অজানা ভয়ে ওর হাত মুখ শক্ত হয়ে আছে। 
 
আমি ওকে স্বাভাবিক করতে। ওর পরিবারের কথা জিজ্ঞেস করলাম। জানতে পারলাম ওর বাবা নেই। দিনমজুর বাবা ট্রাকের চাপা পড়ে মারা গেছে কয়েক মাস আগে। গ্রাম থেকে শহরে এসেছিল একটু ভালো থাকার তাগিদে। সেটাও আর কপালে জুটেনি।
এখন রাস্তায় রাস্তায় সে এটাসেটা ফেরি করে বেড়ায়। 
 
এসব না করলে পেঠে ভাত পৌঁছয় না। তার মা জোর করে একটা রাতের বেলার স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। সেখানেই টুকটাক পড়াশোনা করে সে।
বেশ অনেকক্ষণ পর খেয়াল করলাম তার সাথে একটা মাঝারি সাইজের ব্যাগ। চোখ মুছতে মুছতে বললো, আপা দেখবেন কি আনছি? 
 
আমি একটু হেসে বললাম, দেখি।
সে ব্যাগ থেকে ছোট্ট একটা ড্রেস বের করলো। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। আমি ভাবিনি এমন কিছু দেখব। তাও একটা বাচ্চা মেয়ের ড্রেস। 
 
আমি ওর দিকে তাকাতেই বললো, এটা আমি আমার বোনের জন্য কিনে রেখেছি। বোনকে পরাব বলে।
আমি তখনি বললাম, তুমি জানো তোমার বোন হবে?
হ্যা, মা বলেছে আমার বোন আসবে। তাইত কিনে রেখেছি।
আমি এরপরে কি বলব ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমার চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে আসছিল বার বার। আজ যে বোনটা জন্ম নিবে এই পৃথিবীতে সে নিঃসন্দেহে পরম ভাগ্যবতী। কারণ সে এমন একটা ভাই পাবে৷ যে ভাই সে পৃথিবীতে আসার আগে থেকেই ওর প্রতিক্ষায় প্রহর গুনছে নতুন জামা হাতে।
ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ডাক্তার এসে জানালেন একটা মেয়ে সন্তান হয়েছে। দুজনেই ভালো আছে।
ছেলের অশ্রুসিক্ত নয়ন যেন পরক্ষণেই খুশির ফুলঝুরি তে ভাঁসতে লাগল!
সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। ডাক্তার জানালেন আরও কিছু ফরমালিটি পূরণ করতে হবে৷
আমি আর সুয়েব রিসিপশনের গিয়ে দাঁড়ালাম। তখনি ছেলেটা মানে সুয়েব আমার হাত ধরে টেনে এক কোণায় নিয়ে গেল! 
 
ব্যাগ থেকে একটা মাটির ব্যাংক বের করলো৷ মাঝারি সাইজের ব্যাংক। কিছু বুঝে উঠার আগেই ঠাস করে ভেঙ্গে ফেললো। ব্যাংক প্রায় ভরাই ছিল খুচরো টাকায়।
টাকা হাতে নিতে নিতে বললো। যখন থেকে সে জানতে পেরেছে তার বোন আসবে তখন থেকে সে টাকাগুলো জমিয়েছে। 
 
আমি রোবটের মত দেখছিলাম সবকিছু।
টাকা গুলো গুনে গুনে আমিও দিচ্ছিলাম ওকে।
এরপর সে হাসপাতালের রিসেপশনে গিয়ে টাকা পরিশোধ করল। যা বাকি আছে সে দিয়ে দিবে কাল পরসু। 
 
আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম এইটুকু বয়সে ছেলেটা কত দায়িত্ব নিয়ে ঘুরে!
কতটা মমতা নিয়ে এই বয়সে মা আর বোনের মাথার উপর ছায়া হতে পারে!
কতটা ভালোবাসা ঘিরে আছে ওর দেওয়া সেই ছোট্ট জামায়!
আসলে দায়িত্ব বয়স বুঝে না। 
 
অনবরত আমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল।
টাকা দিয়ে আবার হাত ধরে বাইরে টেনে নিয়ে এলো আমাকে৷ আচ্ছা এই ছেলেটাকেও তো আমি কাল অব্দি চিনতাম না? আর এই কিছুক্ষণের দেখায় এত মায়া জন্মে গেল কিভাবে। আমার হাতে একটা পাঁচ টাকা দামের আইসক্রিম দিয়ে সেও একটা আইসক্রিম নিলো। 
 
আমি খেতে চাইলাম না। সে বললো, আজ খেয়ে নিন অন্যদিন তো খাওয়াতে পারব না। আমার বোন থাকবে আমার সাথে৷ আজ আমার বোনের ভাগটা আপনাকে দিলাম।
ওর চোখে মুখে উচ্ছাস। জীবনটা আসলেই সুন্দর অনেক সুন্দর।
আইসক্রিম খেতে খেতে বিদায় নিলাম তাদের থেকে। 
 
আর মন ভরে দোয়া করলাম ওরা যেন খুব খুব ভালো থাকে সে ব্যবস্থা যেন করে দেন আল্লাহ।
এরকম প্রতিনিয়ত লড়ে যাওয়া সন্তান গুলো যেন সাফল্যের দেখা পায়। স্রষ্টা যেন ন্যায়বিচার করেন।
পৃথিবীতে মা বাবার পরে সবচেয়ে পবিত্র সম্পর্ক ভাইবোনের সম্পর্ক। যে ভালোবাসা নিঁখাদ হয়।
ভালো থাকুক প্রত্যেকটি ভাইবোন৷ 
 
আমিও রাস্তায় চলতে লাগলাম।
হটাৎ ফোন আসলো। কল ধরতেই শুনলাম, আমার সব ছোট্ট বোনটা জিএসসিতে এ+ পেয়েছে। মা অনেক গুলো কল দিয়েছে ফোন সাইলেন্ট ছিল।
এই নিম্নবিত্ত পরিবারে আমিও যে বড় সন্তান! 
 
আমার তিন বোনের বড় ভাই! হ্যা, আমি মেয়ে কিন্তু ভাইয়ের মত করে ওদের মাথার উপর ছায়া হব পিতাহীন এই দুনিয়ায়। এগিয়ে যেতে হবে। কোন থেমে থাকা নয়।
............................ সমাপ্ত .............
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url