আমার হাতে কালি মুখে কালি কবি: কাজী নজরুল ইসলাম || Amar Hate kali mukhe kali Kazi Nazrul Islam



আমার হাতে কালি মুখে কালি 
আমার কালিমাখা মুখ দেখে মা 
পাড়ার লোকে হাসে খালি। 

মোর লেখাপড়া হল না মা 
আমি ম দেখিতেই দেখি শ্যামা। 
আমি ক লিখিতেই কালী বলে 
(মা) নাচি দিয়ে করতালি। 

কালো আঁক দেখে মা ধারাপাতের 
ধারা নামে আঁখিপাতে। 
আমার বর্ণপরিচয় হল না মা 
তোর বর্ণ বিনা কালী। 

যা লিখিস মা বনের পাতায় 
সাগর জলে আকাশ খাতায় 
আমি সে লেখা তোর পড়তে পারি 
(লোকে) মূর্খ বলে দিক না গালি।।
- স্যার, রাইসা ম্যামকে খুঁজে পাওয়া গেছে। কিন্তু উনি ভালো নেই স্যার। এখানে একজন পরিচিত আত্নীয়ার বাড়িতে থাকছেন। একটি সাধারণ প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দিয়েছেন। খুব কষ্ট করে বাচ্চাটিকে বড় করছেন। ছেলেটির বয়স সাত মাস হতে চলেছে। এখানে সবাই জানে উনি বিধবা, আসছে দিন উনাকে উত্তক্ত ও কম করা হয় না। মাটি কামড়ে ওখানে পড়ে রয়েছেন। এখানে উনার আত্নীয়া ছাড়া কেউ থাকেন না। উনি প্রায় পঞ্চান্ন বছরের একজন মহিলা। উনার আপন বলতে কেউ নেই, তাই রাইসা ম্যামকে এখানে থাকার পারমিশন দিয়েছেন। স্যার এখন আমরা কি করবো?
- রাইসাকে যাতে কেউ কোনো রকম ডিসটার্ব না করে সেটা দেখার দায়িত্ব তোমার। আমি খুব দ্রুত চিটাগং আসছি।
বলে ফোনটা রেখে দেয় আবরার। আজ রাইসাকে এতো কিছু সহ্য করা লাগছে এটা শুধু মাত্র তার জন্য। সেদিন যে ভুল করেছিলো, আজ সেই একই ভুল সে করবে না। চোখ দুটো মুছে, স্টেজে চলে গেলো সে। আবরারকে দেখে মহীমা চৌধুরীর হাসি কিছুটা মলিন হয়ে গেলো, তিনি আঁচ করতে পারছেন সামনে আবরার কি করতে যাচ্ছে। মাইকটা হাতে নিয়েই আবরার ডিক্লেয়ার করে দিলো,
- আপনাদের দামী সময় নষ্টের জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত, সামনে এমনটা যাতে না হয় সেটাই চেষ্টা করবো। আজ এনগেজমেন্টটা হবে না। উই আর সরি, যাওয়ার সময় অবশ্যই খেয়ে যাবেন। থ্যাংক উ।
আবরারের ডিক্লেয়ারেশনের পর, মহীমা চৌধুরী যখন তাকে কিছু জিজ্ঞেস করে সে পাশ কাটিয়ে নিজ রুমে চলে যায়। তাকে প্যাকিং করতে হবে। রাইসাকে একবার যেহেতু খুজে পেয়েছে আর হারাতে দিবে না সে। আবরারের এটোতা ঔদ্ধত্য দেখে রাগে ফুসছেন মহীমা সিকদার। কোনোভাবে হেলাল খানকে বুঝিয়ে শান্ত করলেন তিনি। এতোদিনের বন্ধুত্বের খাতিরে উনিও শান্ত হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু আবরারের, তার সাথে কোনো কথা না বলে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়াতে অনেক বেশি অখুশি হলেন মহীমা সিকদার।
রাত ১১টা,
আবরার, অয়ন এবং মহীমা সিকদার মুখোমুখি বসে আছেন। অয়নের অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আবরারের কথায় এই মিটিং এ থাকতে রাজি হয়েছে। নিরবতা ভেঙ্গে মহীমা বেগম বলে উঠলেন,
- হুট করে কি এমন হলো যে আমার মান সম্মানের তোয়াক্কা না করেই তুমি এই প্রোগামটা নষ্ট করে দিলে। তুমি জানো আমি কতোটা অপমানিত হয়েছি? হেলাল আমাকে সম্মান করে তাই কিছু বলে নি। এখন কি আমি জানতে পারি কি এমন হয়েছে?
- আমি কাল চিটাগং যাচ্ছি, ওখানে একটা খুব বড় ইস্যু হয়ে গেছে। আমাদের প্রজেক্ট অর্ধেক কাজেই থেমে গেছে।
- তাহলে সেটা অয়ন হ্যান্ডেল করবে, তাতে কি খুব কিছু যায় আসবে?
- যায় আসবে, মানুষের জানা উচিত সিকদার কোম্পানির মালিক আমি অয়ন নয়। এই এক বছরের ও বেশি আমি ছিলাম না, সবাই অয়নকেই এই কোম্পানির হেড মেনে নিয়েছে। আমি যেন কিছুই পারি না। আমি চাই এই ইস্যুটাকে আমি হ্যান্ডেল করি। আপনার যদি এতে আপত্তি থাকে আমি কিছু বলবো না।
মহীমা সিকদার, আবরারের কথা শুনে মনে মনে খুশি হন। তার মুখে প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠে। অপরদিকে অয়নের মুখেও বাঁকা হাসি ফুটে উঠে। অয়ন খুব ভালোভাবে বুঝতে পারে প্রজেক্টের জন্য এভাবে ছুটে যাওয়ার মানুষ আবরার নয়। অয়ন আবার বলে উঠে,
- এতোদিন এখানে অয়ন সামলে এসেছে, এতো ও কোনো বড় ইস্যু এখানে নেই তাই এই এক মাস অয়ন সামলাতে পারবে। আপনি দুই মাস সময় উনাদের কাছে নিয়ে নেন। আমার উপর ভরসা রাখেন, আমি আপনার বিশ্বাস ভাঙ্গবো না।
- এই না হতো আমার নাতি, আমি উনাদের সাথে কথা বলে নিবো। আর অয়নকে বলে রাখি, ভেবো না এখানের দায়িত্ব তোমাকে দেওয়া হচ্ছে বলে তুমি সব সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। এই একমাস তুমি আবরারের সাবস্টিটিউট হিসেবেই থাকবে।
মহীমা সিকদারের কথা শুনে মুচকি হেসে অয়ন বলে,
- আমি তো সবসময় ভাইয়ের সাবস্টিটিউট ই ছিলাম, এতো ভাববেন না। আমার যদি আর কোনো কাজ না থাকে আমি কি রুমে যাবো?
- হুম, যাও
অপরদিকে,
দরজায় কড়া নাড়লে প্রাপ্তির ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঢুলুঢুলু চোখে দরজা খুলতেই দেখে বাহিরে নিশান দাঁড়ানো। নিশান সেই ব্যাক্তি যার গাড়িতে সেই রাতে প্রাপ্তির এক্সিডেন্ট হয়েছিলো। একজন শুভাকাঙ্ক্ষী, বন্ধুর মতো নিশান প্রাপ্তিকে আগলিয়ে রেখেছে এই চার মাস। প্রাপ্তির অতীত সম্পর্কে সে কিছুই জানে না। প্রাপ্তি যখন বেঁচে উঠেছিলো, তখন তার অতীত জানার অনেক চেষ্টা করেছিলো নিশান। কিন্তু প্রাপ্তির একটাই কথা, তার কিছু মনে নেই। তাই আর ঘাটায় ও নি, তার নাম দেয় খুশবু। অনেকদিন যাবৎ প্রাপ্তির জন্য চাকরি খুজার চেষ্টা করে গেছে সে, কিন্তু পারে নি। তাই নিজের বাড়িতেই একটা রুম ভাড়া দেয় তাকে। নিশানের বাবা-মা খুশবুকে নিজের মেয়ে হিসেবেই ভালোবেসে এসেছে। অসহায় মেয়েটি তাদের ছেলের গাড়ির নিচে পড়ে নিজের বাচ্চাও হারিয়েছে। বাঁচার আশাটুকু ছিলো না। উপর ওয়ালা হাতে ধরিয়ে বাঁচিয়ে দিয়েছে তাকে। নিশান এতো রাতে৷ আশার মতো লোক নয়, হুট করে এতো রাতে তাকে দেখে খুবই অবাক হয় প্রাপ্তি। জিজ্ঞেস করে বসে,
- আপনি? এতো রাতে?
- তোমাকে ডিস্টার্ব করার জন্য সরি। আসলে, আমার এক বন্ধুর ফোন এসেছিলো। তোমার চাকরির ব্যবস্থা সে করে দিতে পারবে। কিন্তু তোমাকে ঢাকা যেতে হবে। আনোয়ার কোম্পানি এন্ড লিমিটেড এর মেইন অফিসে একটি পোস্ট ফাঁকা আছে। আমার বন্ধু ওখানেই চাকরি করে। ও তোমার সি.ভি জমা দিয়ে দিয়েছে। ওরা পরসু ইন্টারভিউ নিবে। তুমি কি যাবে?
- আচ্ছা, আমার কোনো সমস্যা নেই। এমনিতেও আমি ঢাকা যেতে চেয়েছিলাম। অতীতের কিছু প্রশ্নের উত্তর যে আমার চাই।
- তোমার কি কিছু মনে পড়েছে?
- না, তবে ওখানে যেহেতু আমার অতীত তাই, সেখানে গেলেই উত্তরগুলো পাবো।
- বেশ আমি কাল তোমাকে নিয়ে যাবো।
- এতোদিন আমাকে আশ্রয় দেবার জন্য ধন্যবাদ।
- এটা আমার দায়িত্ব ছিলো। আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
- করুন
- তোমার হাসবেন্ডকে যদি খুজে না পাও, তুমি কি তোমার জীবন নতুন করে শুরু করবে না?
- আমি জানি না, আমার প্রশ্নের উত্তর গুলো না পাওয়া অবধি আমি সত্যি ই জানি না কি করবো।
- এতোদিন তোমাকে বলি নি, তবে আজকে কিছু জিজ্ঞেস করবো উত্তর দিবে?
- জ্বী, বলুন
- যদি কোনোদিন অতীতকে প্রত্যাক্ষান করো, তবে কি আমাকে তোমার ভবিষ্যৎ মানাতে পারবে? আজ উত্তর দিতে হবে না। তুমি ভেবেচিন্তে উত্তর দিও।
- আ..আমি কিছু ভাবি নি এই ব্যাপারে।
- প্লিজ ভেবে দেখো।
বলে নিশান বেরিয়ে যায়। প্রাপ্তি তখন ও সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। যতই অয়নের প্রতি রাগ, অভিমান জমে থাকুক সে অয়নের জায়গা কাউকে দিতে পারবে না। অয়ন হয়তো তাকে ভুলে অন্য কাউকে নিজের জীবনে জায়গা দিয়েছে, ধুমধাম করে এনগেজমেন্ট করছে কিন্তু প্রাপ্তি এখনো তার মনের গহীনে অয়ন নামক মানুষটিকে পুষে রেখেছে। সেই অয়নের সাথে বোঝাপড়া এখনো বাকি যে। কিছু প্রশ্নের উত্তর পাবার সময় চলে এসেছে। শুধু সময়ের অপেক্ষা।
দুইদিন পর,
সকাল ৯টার মধ্যে স্কুলে ঢুকতে হবে রাইসাকে। আব্রাহামকে রেখে যেতে মন চায় না। মাত্র বসা শিখেছে ছেলেটা,কিন্তু উপায়ন্তর না পেয়ে চাকরিটা করতেই হবে। রেশমা আন্টি এই বিপদে থাকার জন্য ছাদ দিয়েছেন এই কত! ছেলে আর নিজের ভরণপোষণের খরচটা তো তারই চালাতে হবে। শরীরটা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। প্রেগ্ন্যাসির সময়ের থেকে কিছু কমপ্লিকেশনগুলো রয়েই গিয়েছে। মাঝে মাঝে ভয় হয় ছেলেটাকে একা করে দিয়ে না ফেরার দুনিয়াতে চলে যাবে নাতো সে? না না এসব কি ভাবছে, এখনো কত দায়িত্ব বাকি। চিকিৎসা করাতে হবে, কিন্তু টাকাও লাগবে। এখন বিভিন্ন টেস্ট করতেই দশ হাজার পকেট থেকে খসে পড়ে। রেশমা বেগমের কাছে ছেলেকে বুঝিয়ে দিয়ে স্কুলের দিকে রওনা দিবে রাইসা। দরজাটা খুলে বের হতেই হাত পা জমে গেলো তার। দরজার বাহিরে সেই মানুষটি দাঁড়ানো, যার কাছ থেকে পালাতেই এই দূর শহরে ছেলেকে নিয়ে বহু কষ্টে জীবন কাটাচ্ছে সে। আবরার রাইসাকে প্রায় বছর খানিক পর দেখছে। গোলগাল চেহারার ফর্সা মেয়েটি যেন হাড্ডিসার হয়ে গেছে। আজ তার চোখে সেই ঔজ্জ্বল্য নেই, চোখের নিচের কালি যেন তার নির্ঘুম রাতের বর্ণনা দিচ্ছে। এক পাশে বেনুনি করে কালো শাড়ি পরিহিতা নারীটি এক সময়ে তার সকল হাসির কারণ ছিলো। অথচ আজ এই নারীর সকল কষ্টের কারণ সে। তার জন্য এই নারীটিকে সকল প্রকার বঞ্চনা মুখ বুঝে সহ্য করতে হয়েছে। আবরার দু কদম এগিয়ে রাইসার সামনে এসে দাঁড়ায়। রাইসা এখনো চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে। মনের মধ্যে কিছু ভয়,জড়তারা মনের মধ্যে উঁকি দিচ্ছে। তবে কি আব্রাহামকে কেঁড়ে নিতে এতো দূর চলে এসেছে সে। আবরার নিরবতা ভাঙ্গতে বলে উঠলো,
- কেমন আছিস রাইসু?
-.....
- কথা বলবি না?
-......
- ভয় নেই, ছেলেকে নিতে আসি নি। বরং মা-ছেলে দুজনকেই একসাথে নিয়ে যেতে এসেছি। বড্ড দেরি করে ফেলেছি, তাই নারে? অনেক ভুল করেছি, হয়তো সেই ভুলের ক্ষমা হয় না। কিন্তু এই একটা বছর আমি যা বুঝেছি তা হলো আমার তোকে দরকার, খুব করে দরকার। তুই যে আমার রক্তে মিশে আছিস রাইসা। আমার তোকে ছাড়া চলবে না, এই কয়েক মাস পাগলের মতো খুজেছি তোকে। আমি সেদিন বাধ্য ছিলাম আজ নয়। আমি তোর কাছ থেকে আব্রাহামকে কখনো কেড়ে নিবো না। আমার যে আমার পুরো পরিবার চাই। রাইসু প্লিজ একটা সুযোগ দে, আমি নিজেকে তোর যোগ্য করে তুলবো, তোরে কোনো কষ্ট পেতে দিবো না। প্লিজ রাইসু
এতোক্ষণ চুপ করে আবরারের কথা শুনে যাচ্ছিলো রাইসা। এতোদিনের কষ্টগুলো যেনো তাজা হয়ে উঠেছে আবরারকে দেখে। আবরার যে কথাগুলি বললো, কথাগুলি শোনার প্রতিক্ষা এতোগুলো বছর সে করেছে। চোখ থেকে না চাইতেও সোডিয়াম আর পটাশিয়াম ক্লোরাইড মিশ্রিত জল গড়িয়ে পড়ছে। এটা অতীব খুশিতে নাকি সদ্য তাজা হওয়া মনের ক্ষততে, এটা বুঝতে পারছে না রাইসা। খুব কষ্টে নিজেকে সামলিয়ে বলে উঠে,........
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
ভালোবাসার_উষ্ণতা
দ্বিতীয়_অধ্যায়
৩য়_পর্ব
খুব কষ্টে নিজেকে সামলিয়ে বলে উঠে,
- সময়টাও ঠিক মতো বলতে পারলি না, এক বছর নয়, এক বছর দুই মাস তের দিন। যখন আমার তোকে সবথেকে বেশি দরকার ছিলো, তখন আমি তোকে কাছে পাই নি। তোর কাছে আব্রাহাম কোনোদিন তোর ছেলে ছিলোই না, ও শুধুমাত্র এক রাতে ভুল ছিলো। তুই তো ওকে এবোর্ট করতে চেয়েছিলি। সত্যি বলতে আজ থেকে কয়েকমাস আগেও যদি তুই এই কথাগুলি বলতি আমি মেনে নিতাম। আমি হয়তো তোর ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে তোকে ক্ষমা করে দিতাম, তোর সাথে পরিবার সাজানোর কথাও ভাবতাম। কিন্তু আজ না, কাল তোর দাদীজান আবার যখন আদেশ দিবে তুই আবার আমাকে একা করে দিবি। আফটার অল, তুই কোম্পানির মালিক বলে কথা। এতো সব কিছু পেয়ে সেগুলো ছেড়ে দেওয়ার মতো সাহস কি আদৌ আছে তোর?
- আমি সত্যি বলছি, তুই একবার আমাকে বিশ্বাস করে দেখ। আমি দাদীজানকে ভালোবাসি ঠিকই, কিন্তু উনার অন্যায় আবদার আর মেনে নিবো না। প্লিস রাইসু।
- রাইসু না রাইসা। রাইসা ইসলাম, আমার সাথে তোর কোনোদিন কোনো ছিলো ও না, হবে ও না। ভালো তো বেসেছি, তার শাস্তিও পাচ্ছি। তাই অহেতুক আর কথা বাড়াবো না। আমার তাড়া আছে, নিজের সময় নষ্ট করিস না।
বলেই পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে আবরার হাত টেনে তাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে। কানে মুখ লাগিয়ে বলে,
- বড্ড বেশি অভিমান জমে গেছে, আজ হয়তো আমার কথায় তোর বিশ্বাস হবে না। কিন্তু কথা দিচ্ছি তোর অভিমানগুলোকে আবার ভালোবাসায় পরিণত করবো। নিজেকে তোর এবং আব্রাহামের যোগ্য প্রমাণ না করা অবধি আমি যাচ্ছি না। আমি এজন্য ভালোবাসি না যে তুই আমার বাচ্চার মা, আমি তোকে ভালোবাসি কারণ তুই আমার রন্ধ্রে মিশে আছিস। তোকে যে আমার চাই, খুব করে চাই। তুই আমার হতে বাধ্য।
রাইসা কোনো রকম ধাক্কা মেরে আবরারকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দেয়। আবরার টাল না সামলাতে পেরে খানিকটা দূরে সরে যায়। রাইসার রাগে গজগজ করতে করতে বলে,
- নিজের পাওয়ারের গরম অন্যখানে দিস, আমার কাছে না। কিসের বাধ্য? আমি তোর কাছে কোনো কিছুর জন্য বাধ্য নই। আজ স্পষ্ট শুনে রাখ, আমার জীবনে তোর অস্তিত্ব নেই। আমি তোকে ভালোবাসি না। চলে যা এখান থেকে প্লিজ।
- সেটা সময় বলে দিবে।
রাইসা কথা না বাড়িয়ে গটগট করে সেখান থেকে চলে গেলো। আবরার রাইসার যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে। একটা বড় নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেকে আশ্বস্ত করে,
- আমি পারবো, আমাকে যে পারতেই হবে। প্রমিস করসি, যদি তোর মনে নিজের জন্য জায়গা না করতে পারি তবে আর কোনোদিন তোর সামনে আসবো না। কিন্তু আমি এতো তাড়াতাড়ি হাল ছাড়বো না।
এক সপ্তাহ পর,
সকাল ১০টা,
একটা জরুরি কাজের জন্য অয়ন সামির সাথে দেখা করতে এসেছে। মাস খানিক হয়ে গেছে অয়ন সামির সাথে দেখা করে নি। এখানে এসে জানতে পারে সামি আপাতত দেশে নেই। যেকারণে সামির বড় ভাই আসফির সাথেই মিটিং টা কমপ্লিট করতে হবে। আবরারের অবর্তমানে আনোয়ার কোম্পানি এন্ড লিমিটেড এর সাথে প্রজেক্টটা অয়নকেই কমপ্লিট করতে হবে। এতোদিন পর অয়নকে দেখে আসফি তাকে জড়িয়ে ধরে।
- বেশ শুকিয়ে গেছিস, খাওয়া দাওয়া কি কিছুই করছিস না?
- আর খাওয়া দাওয়া, প্রাপ্তির হাতের রান্নার অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন আর লোকমান কাকার রান্নাও ভালো লাগে না। তোমার খবর বলো, শুনলাম বিয়ের পর নাকি ভাবি তোমার গার্লফ্রেন্ডের সাথে ব্রেক আপ করিয়ে দিয়েছে।
- আর গার্লফ্রেন্ড, এতোদিনের যত মেয়ে ফ্রেন্ড ছিলো তাদের ব্লকলিস্টে পাঠিয়ে দিয়েছে। বু মানেই প্যারা।
- যাক প্যারাটা কারো লাইফে তো আছে।
- তুই কি আর বিয়ে শাদি করবি না?
- যদি কোনোদিন আমার মায়াবতী ফিরে আসে, তখন? তখন তাকে কি উত্তর দিবো বলো? তার অবর্তমানে অন্যকাউকে নিজের জীবনে জায়গা দিয়েছি জানলে আরোও রেগে যাবে ও। আমি ওর স্মৃতি আঁকড়ে ভালোই তো আছি।
- সত্যি ভালো আছিস তো?
- তুমি কি কথাই বলবে? নাকি মিটিং শুরু করবে?
- আচ্ছা, আচ্ছা চল।
অপরদিকে,
আজ এক সপ্তাহ হয়েছে, নিশানের বন্ধুর সাহায্যে এই কোম্পানিতে জব পেয়েছে প্রাপ্তি। একজন কলিগ সামিয়ার সাথে একটা ছোট বাসায় থাকছে সে। মেয়েটি খুবই ভালো, একা একা এতো ভাড়া দেওয়াটা কষ্টকর হয়ে গিয়েছিলো তাই প্রাপ্তিকে তার সাথে থাকতে প্রস্তাব দেয়। শহরে অন্য কোথাও থাকাটাও সুবিধার মনে হচ্ছিলো না দেখে প্রাপ্তিও রাজি হয়ে যায়। প্রতিদিনের মতো নিজ ডেস্কে বসে কাজ করছিলো তখন প্রাপ্তির সিনিয়র এসে জানায়,
- খুশবু, তোমাকে বস ডাকছে মিটিং রুমে। কাল যে ফাইলটা তোমাকে দিয়েছিলেন ওইটাও সাথে নিয়ে যেও। ফাইলটি কমপ্লিট হয়েছে?
- বস তো ক্লাইন্টের সাথে মিটিং এ আছেন। এখনই কি যাবো আমি?
- হ্যা, ফাইলটা ক্লাইন্ট দেখতে চেয়েছে। তুমি গেলেই বুঝবে।
- ঠিক আছে।
মিটিং রুমে দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে থেকেই প্রাপ্তি বললো,
- মে আই কাম ইন, স্যার?
- আরে খুশবু, ভেতরে আসো।
ফাইলটি ভেতরে ঢুকতেই প্রাপ্তির হাত পা জমে গেলো, মাথাটা মূহুর্তে ফাকা হয়ে গেছে। ভেতরে বসে থাকা মানুষটি যে তার খুব পরিচিত। চার মাস পর মানুষটিকে দেখছে সে। আজ যার কাছে কিছু প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষায় এই শহরে তার আগমন, সেই মানুষটির সাথে অতর্কিতে তার দেখা হয়ে যাবে এটা তো জানা ছিলো না। মানুষটা বড্ড শুকিয়ে গেছে, যে চোখের ভাষা এক সময় বিশ্বাস করে ভালোবেসেছিলো তাকে আজ সেই চোখ যেন গর্তের কোটরে চলে গেছে। লোকটাকে দেখে আজকেও মায়া লাগছে। যার রাগ জিদের পুরো ঘর কাঁপতো, আজ বড্ড শান্ত লাগছে লোকটাকে। তার জীবনে তো নতুন মানুষ চলে এসেছে তবে কেনো এতোটা উদাসীন লাগছে তাকে! আসফির কন্ঠস্বর ঘোর ভাঙ্গায় প্রাপ্তির।
- দরজায় দাঁড়িয়ে আছো কেন? ভেতরে আসো, ফাইলটা উনাকে( অয়নের দিকে ইশারা করে) দাও।
- জ্বী স্যার।
এতোক্ষণ মাথা নিচু করে থাকলেও প্রাপ্তির বলা "জ্বী স্যার" যেন ভেতরটাকে নাড়িয়ে দিয়েছে অয়নের। বারংবার প্রাপ্তিকে পাবার আশা এতোটাই নিরাশ করেছে যে আজ আবার সেই আশাটুকুকে পুনোরায় সজাগ করতে মন চাইছে না। চোখ তুলে যদি দেখে মানুষটা ভুল তখন কি করবে? মস্তিষ্কে প্রাপ্তির কথা এতোটাই গেঁথে গেছে যে নিজেই নিজেকে পৃথিবী থেকে আলাদা করিয়ে ফেলেছে। সারাক্ষণ মনে হয় আশেপাশে প্রাপ্তির ছায়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিজেকে খুব কষ্টে সামলে নিয়েছে সে, আবার আশাহত হবার মতো মনের জোর আর যে নেই। তবুও মাথা উঁচিয়ে সামনে বসে থাকা মানুষটির দিকে তাকায় সে। মানুষটি যে আর কেউ নয় প্রাপ্তি, তার মায়াবতী। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে এক মূহুর্ত না দেরি করে জড়িয়ে ধরলো তার মায়াবতীকে।
- প্রাপ্তি, তুমি ফিরে এসেছো। সত্যি ফিরে এসেছো তুমি? কেনো ছেড়ে গিয়েছিলে আমায়? তোমার রাগ হয়েছিলো আমার উপর আমায় বকতে পারতে, তুমি যা শাস্তি দিতে আমি মাথা পেতে নিতাম। তুমি জানো, এই চার মাস পাগলের মত খুঁজেছি তোমায়। কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে তুমি?
অয়নের কাছ থেকে কোনো মতে নিজেকে ছাড়িয়ে বলতে লাগলো প্রাপ্তি,
- আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে স্যার। আমি প্রাপ্তি নই, প্লিজ পাবলিক প্লেসে এমন অসভ্যতা করবেন না।
- প্রাপ্তি এভাবে কেনো বলছো? আমার প্রাপ্তিকে আমি অন্ধকারের মাঝেও চিনে নিবো। তুমি এভাবে কেনো বলছো?
- আবার বলছি আমি প্রাপ্তি নই। আমি আপনাকে চিনি না।
এবার মেজাজ খারাপ হতে লাগলো অয়নের। প্রাপ্তি কেনো নিজেকে তার থেকে আড়াল করতে চাইছে? এতোটা রাগ জমে আছে যে সে অয়নকে চিনতে চাইছে না। নিজেকে সংবরণ করে অয়ন আবার প্রাপ্তির কাছে যায়, তার হাত দুইটি প্রাপ্তির গাল আলতো করে ছুয়ে বলে,
- প্রাপ্তি, তুমিও জানো আমিও জানি তুমি ই আমার প্রাপ্তি তাহলে কেনো অস্বীকার করছো তুমি? রাগ হচ্ছে বলতে পারো, এভাবে আমাদের সম্পর্কটা অস্বীকার তো করো না।
অয়নের হাত দুটো ছিটকে চেঁচিয়ে উঠে প্রাপ্তি,
- বারবার অসভ্যতা কেনো করছেন?? আমি প্রাপ্তি নই আমার নাম খুশবু। আপনি বারবার কেনো জোর করে যাচ্ছেন। আমি আজকের আগে আপনাকে দেখিও নি। স্যার, এইযে আপনার ফাইল। প্লিজ আমি আসছি।
বলেই মিটিং রুম থেকে বেরিয়ে গেলো প্রাপ্তি। দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো সে, পানি ছেড়ে অঝোরে কাঁদতে লাগলো। সে তো চেয়েছিলো এই মানুষটির সাথে জীবন কাঁটাতে। চলে গিয়েও ফিরে আসতে চেয়েছিলো। কিন্তু এই মানুষটার জীবনে তো অন্যকার আগমণ ঘটে গেছে। কেনো ফিরবে সে? এক সপ্তাহ আগে তার এনগেজমেন্ট ও হয়ে গেছে। তাহলে আজ তাকে দেখে এতোটা অনুনয় কেনো করছিলো। কেনো তাকে দেখে মনে হচ্ছিলো, মানুষটা ভাল নেই। গোলকধাঁধার মধ্যে নিজেকে যেনো আউলিয়ে ফেলেছে প্রাপ্তি।
অপরদিকে,
নিজেকে কিছুতে শান্ত করতে পারছে না অয়ন। তার মায়াবতী তাকে চিনতে চাইছে না। অয়নকে উত্তেজিত দেখে আসফি মিটিং রুম ফাকা করে ফেলে। অয়নের কাঁধে হাত রেখে তাকে বলে,
- তোর কোথাও ভুল হচ্ছে, মেয়েটি প্রাপ্তি নয়। ওর নাম খুশবু। এই এক সপ্তাহ হয়েছে ও এখানে জয়েন করেছে। ও তো ঢাকাতেও থাকে না, তোর কোথাও ভুল হচ্ছে।
- দুজন মানুষ এক চেহারার কিভাবে সম্ভব ভাই?
- সেই প্রশ্ন যে আমাকে ভাবাচ্ছে না তা নয়।
- এর শেষ আমি দেখে ছাড়বো। তুমি শুধু আমার একটি কাজ করে দিবে।
- বল কি কাজ?
আসফির সাথে কথা বলে সেখান থেকে বেরিয়ে পরে অয়ন। ডেস্কে এসে জানতে পারে সিকদার কোম্পানির প্রজেক্টটার দায়িত্ব প্রাপ্তিকে দেওয়া হয়েছে। প্রাপ্তি খুব ভালো করে জানে এটা কার কারসাজি। তবে নিজেকে দূর্বল করবে না সে। অয়নকে এবার আর বিশ্বাস করবে না সে। প্রজেক্টের কাজ করতে করতে রাত ১১টা বেজে যায় প্রাপ্তির। একে তো সামিয়া চলে গেছে, উপরে রাত,, এই রাতে একা একা বাসায় যাবে কিভাবে এটা নিয়ে একটা চিন্তায় পড়ে গেলো প্রাপ্তি। অফিস থেকে বের হতেই কেউ একজন পেছন থেকে প্রাপ্তি মুখ চেপে ধরে। প্রাপ্তি কিছু বুঝার আগেই, কালো কাপড় দিয়ে চোখ মুখ বেঁধে তাকে একটি গাড়িতে উঠানো হয়। প্রাপ্তি সর্বোচ্চ চেষ্টা করে গোঙ্গাতে লাগলো। বেশ কিছু সময় পর গাড়িটি কোথাও থামলো। প্রাপ্তিকে টানতে টানতে কোথাও নিয়ে ধাক্কা মারে অচেনা লোকটি। টাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে পড়ে যায় প্রাপ্তি। অচেনা লোকটি তখন প্রাপ্তিকে....
চলবে
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url