দুই আজান নিয়ে কঠিন হুংকার | আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ | জুম্মার দিনে দুই ...
পাঁচ মাসের পেট আর চার বছরের মেয়েকে নিয়ে যখন বাপের বাড়ির দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো তানি তখন দুই ভাই আর দুই ভাবির মুখ গুলোতে বিরক্তিকর ভাব ফুটে উঠে।মা ঘরের একপাশে শুকনো মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।বড় ভাবি এগিয়ে এসে বললেন,
"তানি তোমাকে তো ফোনে বলেছি আমাদের সংসারের অবস্থা খুব একটা ভালো না।তার ওপর তুমি পোয়াতি। এ অবস্থায় কতো খরচের ব্যাপার থাকে।এখন তুমি বলো তো এ অবস্থায় অন্যের সংসারে উঠে আসা ঠিক? তাছাড়া বর্তমান বাজারের যা অবস্থা তাতে দুটো বাড়তি মুখ তো আর কম না তাই না?"
মুখটা ছোট করে দাঁড়িয়ে আছে তানি।গলায় কাটা কাটা লাগছে।মূলত কান্নাটা গলা অবধি এসে আটকে গেছে তাই কাটার মতো সেটা বিঁধে আছে। তবুও নিচু স্বরে বললো,
"ভাবি আমি জানি এ সময়ে তোমাদের ওপর আমরা বোঝা হয়ে আছি।কিন্তু কি করবো বলো?প্রিয়মের ব্যবসায় বড় ধরনের লোকসান হয়েছে। আর লোকসানটা এমন যে যা ছিলো সবকিছু বিক্রি হয়ে গেছে। এখন শুধু মাথার ওপর ছাদটা আছে। কিন্তু তিনবেলা খাবার তো দূরে থাক একবেলা জোগাড়ে তার কষ্ট হয়।তাই বলেছে কিছু সময়ের জন্য যদি আমি বাপের বাড়ি থাকি তবে সে হাতখরচ পাঠাবে।আর ব্যবসায় মোটামুটি একটা ঠিক অবস্থা হলে আমাদের নিয়ে যাবে।"
"হুহ্! তোমার বরের ব্যবসা কখন ঠিক হবে আর ততদিন অবধি তুমি এখানে থাকবে।মনে করো ব্যবসাটা একেবারে জলে চলে গেলো তাহলে কি সারাজীবন বাপের বাড়ি পড়ে থাকবে?"
মুখ ভেংচি কেটে ছোট ভাবি কথা গুলো বলে।চোখের কোণে জল জমেছে তবে তানি সেটা দেখাতে চায় না।সে তখনো দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে।কেউ কিছু না বললে ঘরে তো ঢুকা যায় না অথচ কেউ তাকে ঢুকতেও বলছে না।মা এবার কথা বললেন,
"বৌমা যা কথা হয় তা না হয় পরে বলবে।দেখছো তো মেয়েটার কষ্ট হচ্ছে। কতক্ষণ এভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে।"
"তা কে মানা করেছে না ঢুকতে।থাকতে যখন হবে তখন পোঁটলাপুটলি নিয়ে ঢুকে যেতে বলুন না,আমাদের কি?ভাইয়ের সংসার ভাই নিজে খাওয়াবে আমরা তো খাওয়াবো না।"
কথাটা বলে দুই ভাবিই বড় বড় পা ফেলে নিজেদের রুমে চলে গেলো।ভাবিরা যেতেই ভাইরাও তাদের পিছু ধরলো।এতক্ষণ জমিয়ে রাখা জলটা টুপ করে মেঝেতে পরলো।নিচু হয়ে ব্যাগটা নিতে যাবে তার আগে শাহানা ছুটে এলেন।
"কি করছিস,এ সময় নিচু হতে নেই। আমি নিচ্ছি।চল রুমে গিয়ে আরাম করবি।"
তানি মায়ের সাথে রুমে গেলো।মুখ হাত ধুইয়ে বসতে তানিশা বলে উঠলো,
"মা ক্ষিদে লেগেছে। "
শাহানা বেগম দৌড়ে কিছু শুকনো খাবার এনে মেয়ে আর নাতনীকে দিলেন।তখনি পাশের রুম থেকে আওয়াজ ভেসে এলো,
"তুমি কি বিশ্বাস করো প্রিয়ম একটা টাকাও দিবে?সে তো চালাকি করেছে।পোয়াতি বউকে ভাইদের ঘাড়ে তুলে দিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেখো আমি বলে দিচ্ছি তোমার বোনের জন্য আমি আলাদা কিছু করতে পারবো না আর তুমিও আমাকে এটা সেটার হুকুম দিবে না,যত্তসব। "
তানি নিরব হয়ে সবটা শুনলো।কিন্তু একটা সময় ছিল যখন তানি আসার কথা শুনলে ভাই ভাবিরা খুশিতে আটখানা হতো।শুধু তাই নয়,তানি আসার একসপ্তাহ আগে থেকে রোজ ফোন করতো কখন সে আসবে?আসা বাকি আর তানিকে নিয়ে সবার মাতামাতির শেষ হতো না।এ ভাবি বলে এটা খাও ঐ ভাবি বলে ওটা খাও।কতো আয়োজন হতো তানিকে নিয়ে। যাবার বেলায় আবদার আর কিছু দিন থেকে যাও।তোমার ঘর তোমার সংসার।
খুব ভালো ঘরে তানিকে বিয়ে দেওয়া হয়েছিলো।প্রিয়মের ব্যবসায় কাঁচা পয়সার অভাব ছিলো না।হঠাৎ করে ব্যবসায়ে এমন লস হলো যে হাতে পায়ে যা ছিলো সব গেছে। কিন্তু ব্যবসায় লসে তো বৌ বাচ্চাকে মেরে ফেলা যায় না।তাই একদিন তানির কাছে এসে মুখ কালো করে বলে,
"তানি বলতে আমার লজ্জা করছে তবুও না বলে পারছিনা। এখন তোমার যা অবস্থা তাতে তোমার প্রচুর যত্নের প্রয়োজন কিন্তু এমন একটা বিপদে পড়েছি যে তোমাকে যত্ন করা তো দূরে থাক একবেলা খাবার দিতেও আমি অক্ষম। তুমি যদি কিছু সময় তোমার ভাইদের সাথে থাকো তবে তোমার আর বাচ্চার জন্য ভালো হয়।আমার কাছে টাকা আসলেই আমি পাঠিয়ে দিব।"
তানি স্বামীর মুখের পানে চেয়ে আছে। এ অসময়ে সে যদি ভাবিদের কাছে যায় তারা কীভাবে নিবে?তবুও তানি বড় ভাবিকে ফোনে সবটা জানালে বড় ভাবি ইনিয়েবিনিয়ে তাকে অনেক কথা বলে যার অর্থ তানিকে তার পুষতে পারবে না।তবে প্রিয়মের অবস্থা আর বাচ্চার কথা ভেবে তানি শেষ পর্যন্ত বাপের বাড়িতে হাজির হয়।মুখে তো অনেকে অনেক কিছু বলে তবে কথা আর কাজ কি এক?সেই সুবাদে তানি বাপের বাড়ি উঠলো তবে সে ভুল ছিলো মুখে যতটা কঠোর কথা বলেছিলো কাজে তারচেয়ে জঘন্য ভাবে সেটা প্রকাশ করলো ভাবিরা।
ভাইদের সংসারে উঠে আসায় যে তানিকে এতটা ফল ভোগ করতে হবে কে জানতো?সংসারে প্রায় অনেক কাজ এখন তানিকে করতে হয়।ভাবিরা কাজ করতে বলেন না তবে তানিও চুপ করে বসে থাকতে পারে না।যাদের সংসারে খাচ্ছে তাদের কাজ তো করতেই হবে। তানি কোনো কাজ করতে চাইলে কেউ তাকে বাধাঁ দেয় না।অনেক কষ্ট নিয়ে তানি এটা সেটা করে দেয়।তবুও কথার মাঝে খোঁচা দিয়ে ভাবিরা বিভিন্ন কথা বলে উঠে।তানি সবটা সহ্য করে নেয়।
আজ বাড়িতে উৎসব উৎসব ভাব এসেছে। ছোট বোন তনিমা এসেছে তার হাসবেন্ডকে নিয়ে তাই দুই ভাবির ব্যস্ততার শেষ নেই।ছোট বোন আসবে তাই মা বলেছে প্রিয়মকেও খবর দিতে। প্রথমে ইচ্ছে হয় নি পরে তাকে আসতে বললো
খাবার টেবিলে সবাই খেতে বসেছে।জামাই আদর নিয়ে সবার মাতামাতি তবে তানির বরকে নিয়ে নয় তনিমার বরকে নিয়ে। বড় ভাবি ছোট জামাইকে এটা ওটা তুলে দিচ্ছে তিনি খেতে না চাইলেও জোর করা হচ্ছে। এদিকে প্রিয়মের প্লেটে একটা ডিম আর সামান্য ঝোল ছিল সে তা দিয়ে নিরবে খেয়ে যাচ্ছে। তাকে সাধাসাধি করার যেন কারো সময় নেই। তানি একদৃষ্টিতে বরকে দেখছে।সবাই অন্যদিকে ব্যস্ত হলেও তানি লক্ষ্য করেছে প্রিয়ম নিচু হয়ে কাঁদছে।
খাবারের পর্ব শেষ হতেই সবাই আড্ডা মাতাতে বসেছে।এমন সময় তানি তার ব্যাগ নিয়ে বের হলো।শাহানা মেয়েকে এভাবে দেখে জিজ্ঞেস করে,
"কিরে মা ব্যাগ নিয়ে কই যাচ্ছিস?"
"মা আমরা চলে যাচ্ছি। আসলে অনেকদিন হলো এ বাড়িতে আছি তাই ভাবলাম এবার আমাদের আসা উচিত।তাছাড়া কথিত আছে, দীর্ঘদিন এক জায়গায় পড়ে থাকলে পোষা কুকুরের প্রতিও মানুষের অবহেলা দেখা দেয় আর আমি তো মানুষ তাই না?তবে যাওয়ার আগে তোমাদের একটা কথা বলে যাই সবার পরিস্থিতি সবসময় একরকম থাকে না।আজ হয়তো আমার স্বামীর অবস্থা শোচনীয় তাই তোমাদের আশ্রয়ে এসেছিলাম কিন্তু কাল যে তোমাদের হবে না তার নিশ্চয়তা কী? অর্থ দিয়ে যদি মানুষের যত্নের পরিমাণ বেড়ে যায় তবে সেই অর্থাভাবে কিন্তু মানুষকে অপমানিত হতে হয় তা তোমাদের থেকে শিখলাম।একদিন হয়তো পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে ঠিকই কিন্তু তোমরা আমার দুঃসময়ে যে আচরণ টা করলে সেটা হয়তো আজীবন মনে গেঁথে থাকবে।
আর তনিমা তোকেও একটা কথা বলি,তুই আমার বোন।ভাবিদের সাথে কাঁধ মিলিয়ে তুই ও আমার সাথে যে আচরণটা করলি মনে রাখিস কোনোদিন হয়তো তোকেও আমার অবস্থায় আসতে হবে।ভুলে যাস না তুই যেমন এ বাড়ির মেয়ে তেমনি তোর বরও এ বাড়ির জামাই।মেয়েরা সব সইতে পারে কিন্তু স্বামীর প্রতি অবহেলা আর অপমান তারা কখনো সইতে পারে না।"
তানি আরকিছু না বলে সোজা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো।প্রয়োজনে স্বামীর ঘরে উপোসে মরবে তবুও আর সেই ঘরে যাবে না যেখানে তাদের সম্মান বলতে কিছুই নেই।সবার দিন একরকম যায় না,এক মিনিটে যে অর্থের সাগরে ডুবে থাকে এক সেকেন্ডে সে কাঁদায় পরিপূর্ণ হয়।সৃষ্টিকর্তা সবাইকে সাময়িক পরীক্ষা দিয়ে থাকেন আবার উদ্ধারও করেন। শুধু একটু ধৈর্য্য আর একটু সবর!
সমাপ্ত
#পরীক্ষা
#তানিয়া